ডেভিড ওবুয়া, উত্থান ও পতনের সাক্ষী

কেনিয়া শব্দটা মাথায় আসলেই ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে দুটো শব্দের উদয় হয় – ক্রিকেট এবং আক্ষেপ। সীমিত সামর্থ্য নিয়েও এই শতাব্দীর শুরুর দিকে দেশটি দেখিয়েছিল ক্রিকেটীয় প্রতিভার ঝলক। সবাইকে চমকে দিয়ে ২০০৩ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলে দলটি। যদিও কেনিয়ার ক্রিকেট অবকাঠামো বলতে কিছু ছিল না।

সবেধন নীলমণি হিসেবে ছিল একমাত্র আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম নাইরোবি স্টেডিয়াম। হাতে গোণা কয়েকটি পরিবার থেকেই উঠে এসেছিল কেনিয়ার ইতিহাসের সেরা সব ক্রিকেটাররা। এদের মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন ওবুয়া ভাইয়েরা। তিন ভাই-ই একসাথে চুটিয়ে খেলেছেন জাতীয় দলে। আমাদের আজকের গল্পটা ওবুয়া ভাইদের মেজভাই, ডেভিড ওবুয়াকে নিয়ে।

১৯৭৯ সালে নাইরোবিতে জন্ম হয় ডেভিড ওবুইয়ার। ছোটবেলা থেকেই ছয় বছরের বড় কেনেডি ওটিয়ানোর সাথে বাড়ির আঙ্গিনায় খেলতে খেলতে ক্রিকেটের প্রেমে পড়া। বড় ভাইয়ের মতো ডেভিডও ছিলেন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। যদিও জাতীয় দলে ভাইয়ের দারুণ পারফরম্যান্সের সুবাদে ডেভিডের কিছুটা দেরিতে অভিষেক হয়।

অবশেষে ২০০১ সালে ইনজুরির কারণে কেনিয়া দল থেকে বাদ পড়লে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সবুজ জার্সিতে অভিষেক হয় তার। সেই ম্যাচে তার আরেক ভাই লেগস্পিনার কলিন্সেরও অভিষেক ঘটে। পরবর্তীকে কেনেডি অস্ট্রেলিয়াতে ক্লাব ক্রিকেট খেলার সিদ্ধান্ত নিলে জাতীয় দলের নিয়মিত উইকেটরক্ষক বনে যান ডেভিড। যদিও অভিষেকটা মোটেও সুখস্মৃতি ছিল না তার জন্য, আউট হয়ে যান ২৮ বলে সাত রান করে।

দ্বিতীয় ম্যাচে আলো ছড়াতে না পারলেও তৃতীয় ম্যাচে ৩৪ রান করে জানান দেন ফুরিয়ে যাবার জন্য আসেননি তিনি। পাশাপাশি উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে দারুণ দুটো ক্যাচ লুফে নেন সে ম্যাচে। কিন্তু তার সকল প্রচেষ্টাই বৃথা যায়, ক্যারিবীয়রা ম্যাচ জিতে নিয়েছিল সাত উইকেটে।

এরপর ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আয়োজিত ত্রিদেশীয় সিরিজের দলেও জায়গা পান তিনি। ভারতের বিপক্ষে ২৬ রান করার পাশাপাশি দুটো ক্যাচও ধরেন। সে ম্যাচে ভারতকে ৭০ রানে হারিয়ে পুরো বিশ্বকে চমকে দেয় কেনিয়া। পরের দুই বছর তিনি রানের মাঝেই ছিলেন। বড় ইনিংস খেলতে না পারলেও ছোট কিন্তু কার্যকরী বেশ কয়েকটি ইনিংস ছিল তার। ২০০৩ বিশ্বকাপে কেনিয়া দলের সদস্য ছিলেন তিনি। সে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলা ছিল কেনিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা সাফল্য।

ডেভিড তার ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশতকের দেখা পান জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ওপেনিংয়ে নেমে ৫৭ রানের দারুণ এক ইনিংস খেললেও বোলারদের ব্যর্থতায় ম্যাচটা হেরে যায় কেনিয়া। এরপরের কিছুটা বাজে ফর্মে পড়েন ডেভিড। ফলশ্রুতিতে দল থেকে বাদ পড়ে যান। তিন বছর পর ২০০৬ সালে জাতীয় দলে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি।

স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন ৭৩ রানের চমৎকার এক ইনিংস। কেনিয়া সে ম্যাচটি জিতে নেয় ১৯০ রানে। ব্যাটে রানের ফল্গুধারা অব্যাহত থাকে পরের ম্যাচেও, বারমুডার বিপক্ষে অপরাজিত থাকেন ৭৪ রান করে। আইসিসি ওয়ার্ল্ড লিগ ডিভিশন ওয়ানের ফাইনালে খেলেন ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ৯৩ রানের ইনিংস।

২০০৭ বিশ্বকাপ কেনিয়া কিংবা ডেভিড কারো জন্যই সুখকর ছিল না। কেনিয়া বাদ পড়ে যায় বিশ্বকাপের গ্রুপপর্ব থেকেই। ২০০৯ সালে পুনরায় রানের মাঝে ফিরে আসেন তিনি, টানা তিন ম্যাচে খেলেন চল্লিশোর্ধ ইনিংস। ২০১০ সালে আইসিসি ইন্টারকন্টিনেন্টাল টুর্নামেন্টে অংশ নেন তিনি। টুর্নামেন্টের ম্যাচগুলোকে প্রথম শ্রেণির ম্যাচের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল।

সেই টুর্নামেন্টে ডেভিড দুই শতক এবং আট অর্ধশতক হাঁকান। পরের বছরের প্রায় পুরোটা সময় ডেভিড ইনজুরির কারণে মাঠের বাইরে কাটান। ২০১১ বিশ্বকাপের জন্য ঘোষিত কেনিয়া দলে জায়গা পান তিনি। কলম্বোতে প্রথম ম্যাচেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫১ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন তিনি।

ছোটভাই কলিন্সের সাথে গড়েন ৯৪ রানের জুটি। কিন্তু তাদের বিদায়ের পর ধ্বস নামে কেনিয়ার ইনিংসে। ফলশ্রুতিতে নয় উইকেটের বিশাল ব্যবধানে ম্যাচটি হেরে যায় তাঁরা। কিন্তু শুরুটা দারুণ হলেও বিশ্বকাপের বাকি সময়টা দুঃস্বপ্নের চেয়েও বাজে কাটে ডেভিডের। সবমিলিয়ে করতে পারেন কেবল ১৪ রান!

২০১২ সালে মোম্বাসায় আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটিই হয়ে আছে তার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ হিসেবে। সবুজ জার্সিতে ৭৩ ম্যাচ খেলে ছয় অর্ধশতকে তাঁর সংগ্রহ ১,৩৫৫ রান। দেশের হয়ে দশটি আন্তর্জাতিক টি টোয়েন্টি ম্যাচও খেলেছেন তিনি। সেই ম্যাচগুলোতে দুইটি অর্ধশতক হাঁকান তিনি।

ক্যারিয়ারের শুরুতে অংশ ছিলেন কেনিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা সময়ের। কিন্তু ক্যারিয়ারের শেষভাগে এসে দেখতে হয়েছে কেনিয়ার ক্রিকেটের করুণ পরিণতি। কেনিয়ার ক্রিকেটের নিঃশব্দ মৃত্যু কি আজও কাঁদায় ডেভিড ওবুয়াকে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link