‘অনালোচ্য’ প্রতিভা ডুডলে নার্স

নার্সের রান ২০৮। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। গোটা ম্যাচে নার্স আর ফিল্ডিং বা ব্যাটিং কোনোটাই করেননি। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট জিতে নেয় ৭১ রানে। সেই ম্যাচেরই এক কুশীলব, ডেনিস কম্পটন পরে বলেন, ‘প্রায় প্রতি বলের পর নার্স আঙুলের ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলেন। গ্যালারিতে বসা দর্শকদের ধারণাই নেই, কতটা ব্যাথা ভোগ করে রান গুলো করেন নার্স।’

আজকাল ইন্টারনেটে গ্রায়েম স্মিথের ভাঙা আঙুল নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাট করতে নামার ভিডিও খুব জনপ্রিয় হয়েছে। এবং সঙ্গত কারণেই হয়েছে। কিন্তু তাঁর ৫৮ বছর আগে যে আরেক দক্ষিণ আফ্রিকান অধিনায়ক সেই একই রকম বিক্রমের কাজ করেছিলেন, সেটা মনে রাখা তো দূর, বেশিরভাগ ক্রিকেটপ্রেমী সেই ঘটনা সম্পর্কে অবগতই নন।

ট্রেন্টব্রিজে ১৯৫১ সালের দক্ষিণ আফ্রিকার ইংল্যান্ড সফরের প্রথম টেস্ট। তার আগে একটা প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ফিল্ডিং করতে গিয়ে তাঁর বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ভেঙে যায়। ডাক্তার তাঁকে দুটো বিকল্প দেন, হয় আঙুলে প্লাস্টার করো দু’মাস খেলা থেকে দূরে থাকার বিনিময়ে, নয়তো ভেঙে যাওয়া হাড়টি পিন দিয়ে ম্যাচটি খেলো, বিশাল ব্যাথার বিনিময়ে।

নার্স তখন ৪০ বছর বয়সী এবং দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক। সম্ভবত এটিই তাঁর শেষ সফর। কাজেই গুরুত্বপূর্ণ সফরে দু মাস বসে যাওয়া মানেই, তাঁর ক্রিকেটজীবনও চিরকালের জন্য অর্গলবদ্ধ হয়ে পড়া। নার্স দ্বিতীয় বিকল্পটি বেছে নেন। ১০৭ রানে ২ উইকেট, এই পরিস্থিতিতে ক্রিজে আসেন নার্স। ইংরেজ বোলিং আক্রমণ ওয়ার্ডলে, টাটার্সাল, বেইলি ও বেডসার সমেত বেশ ধারালো। আর দক্ষিণ আফ্রিকা দলও চরম অনভিজ্ঞ।

ভবিষ্যৎ অধিনায়ক জ্যাকি মাকগ্লু , প্রবাদপ্রতিম উইকেট রক্ষক জন ওয়েট সহ ৪ জনের অভিষেক হয় সেই ম্যাচে। ওই সময় দক্ষিণ আফ্রিকার আরেক উইকেট পড়ে যাওয়া মানে, ইংল্যান্ড ম্যাচ শাসন করার পাসওয়ার্ড পেয়ে যাবে। বটগাছ যেমন ভাবে ছায়া দেয়, সেভাবেই গোটা মিডল অর্ডার ও লোয়ার অর্ডারকে ছায়া দিয়ে যখন রান আউট হলেন নার্স, নবম উইকেটের পতনে দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর তখন ৪৮২।

 

নার্সের রান ২০৮। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। গোটা ম্যাচে নার্স আর ফিল্ডিং বা ব্যাটিং কোনোটাই করেননি। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট জিতে নেয় ৭১ রানে। সেই ম্যাচেরই এক কুশীলব, ডেনিস কম্পটন পরে বলেন, ‘প্রায় প্রতি বলের পর নার্স আঙুলের ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলেন। গ্যালারিতে বসা দর্শকদের ধারণাই নেই, কতটা ব্যাথা ভোগ করে রান গুলো করেন নার্স।’ ট্রেন্টব্রিজের সেই জয়, তাঁর অধিনায়ক হিসেবে একমাত্র।

নার্স যে সময় খেলতেন, সেই সময় দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে ধারাবাহিক ব্যর্থতার যুগ ছিল। তাঁর ৩৪ টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকা যেতে মাত্র দুটিতে। এই কারণেই কিনা কে জানে, টেস্ট ম্যাচে ৫৩.৮১ গড় নিয়েও দক্ষিণ আফ্রিকার সেরা ব্যাটসম্যানের আলোচনায় নার্স আসেন না। এই কারণে না হলে, স্রেফ আরেকটি কারণেই তিনি এত বিস্মৃত হয়ে যেতে পারেন। তা হলো প্রাক-অপার্থেইড দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট নিয়ে ক্রিকেটপ্রেমীর অজ্ঞানতা।

ক্রিকেট বিশুদ্ধবাদীরা অবশ্য ওই ব্যাথাকে জয় করা ট্রেন্টব্রিজ ইনিংসেরও আগে রাখেন ১৯৪৭ এ ওল্ড ট্রাফোর্ডে তাঁর করা ১৪৪ মিনিটে ১১৫। ম্যাচের তৃতীয় ইনিংসে এড্রিচ, রাইট, বার্নেটের বিরুদ্ধে ওই ইনিংস প্রতক্ষ্যদর্শীদের মতে, ‘টেকনিকাল ব্রিলিয়ান্সের পরাকাষ্ঠা।’

আরেকটি বিখ্যাত ইনিংসের কথা না বললে, নার্স উপাখ্যান সম্পূর্ণ হবে না। কয়েকদিন আগেই ম্যাকেব কে নিয়ে লিখেছিলাম, ম্যাকেবের অন্যতম বিখ্যাত ইনিংস ১৯৩৫-৩৬ এ জোহানেসবার্গে ম্যাচের শেষ দিন করা ১৮৯। সেই ইনিংসের প্রভাব ছিল এমনই যে, দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক হার্ভে ওয়াডকে ফিল্ডাররা চোট পেতে পারেন, এই মর্মে আলোর আবেদন করতে হয়।

ম্যাককেবের সেই ইনিংস ঢেকে দেয় সেই টেস্টেই তৃতীয় ইনিংসে করা এই নার্সের ২৩১। প্রথম ইনিংসে ম্যাককর্মিকের গতিতে ০ রানে আউট হন। দ্বিতীয় ইনিংসে, ভাঙতে থাকা আঢাকা পিচে গ্রিমেট, ফ্লিটউড-স্মিথ এবং ওরাইলীর স্পিন ত্রয়ীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কঠিন হবে বলেই প্রচলিত ধারণা। কিন্তু নার্স এই ধারণাকে প্রিটোরিয়ার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেন।

ধীর গতিতে শুরু করে, এক সময় এমন খেলা শুরু করেন যে অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক ভিক রিচার্ডসন, চাক ফ্লিটউড-স্মিথ কে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এর থেকে নিষ্কৃতি কিভাবে পাবো বোলো তো?’ ছোট্ট জবাব চাকের, ‘ওকে গুলি করে দাও।’

জীবনে ইংল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া কোথাও টেস্ট খেলেননি নার্স। তাঁর পিতা ডেভ নার্সও দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের এক মহীরুহ। যে সময় ডুডলে জন্মান, ডেভ সে সময় সদ্য অস্ট্রেলিয়াতে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২০০ করে ফিরেছেন। কতকটা সেই জন্যই নিজের ছেলের নাম রাখেন দক্ষিণ অস্ট্রেলীয় গভেরনারারের নামে। বাবা এত বড় ক্রিকেটার হয়ে সত্ত্বেও কখনো ডুডলে কে প্রশিক্ষণ দেননি।

শোনা যায় বলেছিলেন, ‘আমি শিখেছি বেড়ায় বল মেরে মেরে। তুমিও তাই শেখো।’ ব্যাটসম্যান হিসেবে কখনোই খুব দেখনদারিতে বিশ্বাস করতেন না নার্স। ডিফেন্সের ওপর দাঁড়িয়েছিল তাঁর খেলা। ১৯৩৫ থেকে ১৯৫১-এই সময়ে খেলেছেন নার্স। জীবনের সেরা সময়টা, সে যুগের বহু বড় খেলোয়াড়ের মতোই সোপে দিয়েছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কে। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার প্রাক যুদ্ধ (১৯৩৫-১৯৩৯) ১৪ টেস্টে ওনার গড় ৪৯, এবং যুদ্ধ পরবর্তী ২০ টেস্টে (১৯৪৭-১৯৫১) তাঁর গড় ৫৬।

আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার সেরা ব্যাটসম্যান নিয়ে আলোচনা যখন করি, জ্যাক ক্যালিস, এবি ডি ভিলিয়ার্স, ব্যারি রিচার্ডস, আমলা, স্মিথ, গ্রেম পোলক সকলের কথা বলি। অথচ উপেক্ষিত রয়ে যান ডুডলে নার্স।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...