মাত্র ২০ বছরের এক ছোকড়া সাদা পোশাক জড়িয়ে ফেলেছে। মানুষের ভ্রু খানিক কুচকে গেল। এই ছেলের তো প্রথম শ্রেণি ক্রিকেটে কোন শতকই নেই। এ কি করে খেলবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে? তাও আবার খেলতে নেমেছে শন পোলক, মাখায় এনটিনি, আন্দ্রে নেল ও জ্যাক ক্যালিসদের মত বোলারদের বিরুদ্ধে। এ ছেলে তো মাঠে মারা পড়বে! ঠিক এমন প্রতিক্রিয়াই ছিল যখন ডোয়াইন স্মিথ প্রথম খেলতে নেমেছিলেন টেস্ট ক্রিকেট।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে প্রথম যেবার তিনি খেলতে নেমেছিলেন সেবার তাঁর প্রতিপক্ষ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। বেশ শক্ত প্রতিপক্ষ! তাছাড়া কি ভয়ংকর সব বোলারকে সামলাতে হয়েছিল তাঁকে। প্রথমে এত কঠিন পথ পারি দেওয়া তো আর সহজ কাজ নয়। তারুণ্যের রক্ত তখনও টগবগে। সে রক্তের চাপ সামলে দাঁতে দাঁত এঁটে টিকে থাকাটা দায়। আর সমালোচনার একটি বাড়তি চাপ তো ছিলই।
তাছাড়া তিনি যখন ব্যাট হাতে বাইশ গজে নেমেছিলেন তখন ক্যারিবিয়ানরা চার উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল। ৪৪১ রানের বিশাল টার্গেটে ব্যাট করতে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান ছিল তখন কেবল ২২৪। এমন এক পরিস্থিতিতে মাত্র ২০ বছরের এক তরুণ বাইশ গজে নেমে এমন কি ই বা করতে পারতেন? কিন্তু সকল সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে তিনি দূর্দান্ত এক ইনিংস খেলে ফেললেন। প্রোটিয়া ওমন বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে ভয়ডরহীন এক ব্যাটিং প্রদর্শন।
১৫ চার ও দুই ছক্কায় ১০৫ রানের দ্যুতি ছড়ানো এক ইনিংস খেলে সমালোচকদেরকে মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছিলেন ডোয়েন স্মিথ। বেশ একটা সম্ভাবনা জাগানিয়া আগমন। অথচ প্রথম শ্রেণি ক্রিকেটে তাঁর খুব একটা আলোড়ন তখন অবধি ছিল না। মূলত ব্যাট আর বলের দারুণ সংযোগ ঘটাতে পারতেন স্মিথ। পেশির জোরটা আর পাঁচটা ক্যারিবিয়ান খেলোয়াড়দের মতোই। ব্যাটিং স্টাইলও ছিল চোখের জন্যে আরামদায়ক। তবে একটা আক্ষেপ যেন পিছু ছাড়েনি তাঁর। তিনি খুব বেশি লম্বা করতে পারেননি নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার।
টেস্ট ক্যারিয়ারটা থেমে থাকে মাত্র দশ ম্যাচেই। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারদের একটা ঝোঁক ছিল। তাঁরা লম্বা ফরম্যাটটায় খুব বেশি যেন মনোযোগ দিতে চাইতেন না। সেই মিছিলে যোগ দিয়েছেন ডোয়েন স্মিথও। তবে দুভার্গ্য মাত্র এক টেস্ট সেঞ্চুরিতে আটকে যাওয়া ব্যাটারের ভাগ্য খোলেনি ছোট ফরম্যাটেও। সেখানেও নিজের সামর্থ্যের স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটাতে তিনি ব্যর্থ হন। তবুও যে খুব একটা খারাপ সময় পার করেছেন রঙিন পোশাকে তা বলার উপায় নেই।
তবে টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে ক্রিকেটে তাঁর ব্যাটিং গড়টা আবার সন্তোষজনক না। ধারাবাহিকতার বড্ড অভাব সেখানটায়। দুই ফরম্যাটেই তাঁর গড় আঠারোর ঘরে। যেন সে গণ্ডিটা পার হওয়ার কোন উপায়ই জানা ছিল না। ধারাবাহিকতার অভাব থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন। এমনকি টানা দুইবার টি-টোয়েন্টি শিরোপা জেতা দলেও তিনি ছিলেন। শুধু ছিলেন বললে, ভুল বলা হয়।
তিনি রীতিমত কঠিন পরিস্থিতিতে দলকে নিয়েছেন জয়ের বন্দরে। ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪৬ বলে ৬৩ রানের ইনিংস খেলে দলকে জয়ের পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। আবার ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মাটিতে বাংলাদেশের বিপক্ষেই খেলেছিলেন ১৬৭.৪৪ স্ট্রাইকরেটে খেলেন ৪৯ বলে ৭২ রানের এক দূর্দান্ত ইনিংস। তবে ধারাবাহিকতার অভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এক তারকা হয়ে থাকা হয়ে ওঠেনি তাঁর। তাইতো ২০১৭ সালে অবসরে চলে যান।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেও ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ঠিকই চালিয়ে গেছেন তিনি। ভারতের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের দল মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স ও চেন্নাই সুপার কিংসের মত চ্যাম্পিয়ন দলের হয়ে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। তাছাড়া ২০১৪ সালে চেন্নাই শিবিরে দূর্দান্ত সময় পার করেছেন তিনি। হয়েছিলেন সে আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। সেই সাথে পাঁচটি অর্ধশতকও এসেছিল তাঁর ব্যাট থেকে।
ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে নিজের জাত জেতাতে পেরেছিলেন তিনি। তবে সেই যে ধারাবাহিকতার অভাব। সেখানটাও লম্বা সময় ধরে হাসেনি স্মিথের ব্যাট। এখন তো রীতিমত লোকচক্ষুর আড়ালে তিনি। নামিদামী ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ গুলোও খেলা হয় না তাঁর। অথচ এক সময় তিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল), বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল),পাকিস্তান সুপার লিগসহ (পিএসএল) নানান টুর্নামেন্টে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মতোই ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট থেকে প্রস্থান হয় তাঁর। ধারাবাহিকতা অভাবে সম্ভাবনার ধুকে ধুকে মৃত্যু।