ডিয়ার আইকনেষু

আপনার ভাগ্যকুণ্ডলী কোনো অদৃশ্য আলোর সুতোয় বাঁধা। এ নিয়ে কারও কোনো দ্বিমত আছে বলে মনে হয় না। আর পাঁচজন সাধারণ ভেতো বাঙালির থেকে আপনার রানিং ট্র‍্যাকটা বেঁকতে বেঁকতে একেবারে সটান চলে গেছে অ্যাডিলেডে, যেখানে বিদায়ের অস্তরাগে দাঁড়ানো স্টিভ ওয়াহ’র জন্য তার ডেরায় গিয়ে আপনি সাতজনকে অফ কর্ডন আর শর্ট লেগে ফিল্ড প্লেস করে পাঁজরে বল ফেলতে পারেন।

ব্রিসবেনের গ্যাবায় অজি পেসার জেসন গিলেস্পির বল নড়তে শুরু করলে পন্টিং-এর সাজানো গালি আর থার্ডস্লিপের মাঝখান দিয়ে গলাতে পারেন হিরোহন্ডার ফেসটা – চাঁদের পাহাড়ে শঙ্করকে স্বপ্নের পুরুষভাবা বাঙালি আদতে অসহায়, অন্তত ক্রিকেটের মতো ধর্মে সে অধার্মিক!

নব্বই বছরের ইতিহাসে পঙ্কজ রায়ের পর একটা সুপারস্টার তৈরী করতে তাঁদের অপেক্ষা করতে হয়েছে

প্রায় পাঁচ পাঁচটা দশক! বুকে হাত রেখে বলতে পারি একটা বাঙালি ভরকে আপনি সেন্টার অফ গ্র‍্যাভিটি হয়ে টেনে নিয়ে এসেছেন বাইশগজে, জাতীয়তাবাদ আর প্রাদেশিকতার মাঝখানে আপনি সেই উদ্দাম প্রলোভন যাকে অস্বীকার করতে পারে নি একটা প্রজন্ম। হ্যাঁ, আবেগ কারও কম, কারও বেশি- এ তো কালের নিয়ম।কিন্তু আপনার আইকনত্বের প্রশ্ন কোনোদিন উত্তর দাবী করে নি।

বাঙালির যে ক্রিকেট প্রতিভার কমতি ছিল তা তো না, কিন্তু একটা সৌরভ গাঙ্গুলি তো শুধু ক্রিকেটার নন,সৌরভ তো সেই কলার তোলা লোকটা যে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করে নিজেকে পুরিয়ে নিখাদ করেছে ভারতীয় ক্রিকেটকে,সেই উদ্ধত মেরুদণ্ড যা সোজা থেকেছে এক যুগ ধরে, সামনে ওয় থেকে পন্টিং, পোলক থেকে ইনজামাম, বোর্ডের রাজনীতি থেকে বুকিদের প্রলোভন কতকিছুই তো এলো গেল- তবু নড়ল না সেই শিরদাঁড়া!

আইকনেষু,

আপনার একটা পদক্ষেপ অন্ধের মতো আগলে রাখে অজস্র বাঙালি, হিতাহিতের বিচার করার আগে তারা ভেবে নেয় হিত আর আহিতের মাঝখানে একটা সৌরভ আছে, এই জায়গাটা একদিনে তৈরী হয়নি, একটা সৌরভ গাঙ্গুলি নামক বাঙালির সুপারস্টার তৈরী হতে লেগেছে ২৫ টা বছর – সেই লর্ডসের ডেবিউ সেঞ্চুরি থেকে ভারতীয় ক্রিকেটের মসনদ অবধি- আপনার ভাগ্যরেখা আপনি লিখেছেন – সে বড় আদরের ধন আমাদের।

আপনার অসুস্থতা কোথাও গিয়ে হয়ে গেল বাঙালির মনখারাপ। উডল্যান্ডস হাসপাতালে আপনার বুকে স্টেন্ট বসার মুহুর্তে নির্বিকার সৌরভ গাঙ্গুলি হয়েছিল বাংলার হৃদস্পন্দন।

কিন্তু কীভাবে এই উন্মাদনার ধুলো অচিরেই লেগে গেল আপনার গায়ে? ঐ যে আপনি আর পাঁচজনের মতো নন-ছিলেন না কোনোদিনই! কিন্তু সে তো তাত্ত্বিক কথা। খোকন সেন যখন কলকাতায় প্রথম ক্রিকেটটা খেলতে শুরু করলেন বাঙালি তখন দেখছে ফুটবলে মহামেডানের স্বর্ণযুগ।

সচল আগ্নেয়গিরি সুঁটে ব্যানার্জি, মন্টু ব্যানার্জি হয়ে পঙ্কজ রায়ের বাইশ গজে পা পড়া বাঙালিকে কিছুটা ক্রিকেটমুখী করে দিল। কিন্তু সত্তর-আশির দশকে গোপাল বসু থেকে সুব্রত ব্যানার্জি- বাঙালির বঞ্চিতের অভিমানী তালিকায় আপনি জ্বলে দিলেন স্ফুলিঙ্গ। লর্ডসে তো শুধু আপনি হেলমেটটা খোলেন নি, বাঙালি খুলেছিল। বাঙালি যেন ঐ প্রথম শেষ গণ্ডুসটা মুখে তুলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে জানিয়েছিল তাঁর পূর্ণতার কথা।

আপনি, আপনিই তো এই বৃত্তটা সম্পূর্ণ করলেন। বাঙালি অবহেলিত থেকে বাঙালিই পারে অবধি এই আশ্চর্য যাত্রাটা আপনার অফস্টাম্পে এসে ফিনিশ হল। আবার হয়ত শুরু হবে অপেক্ষা, হয়েওছে।

তবু সে শিরীষ গাছের ছাওয়ায় পড়ে থাকা ক্রিকেটব্যাট জানবে না, ময়দানের প্রাজ্ঞ ক্রিকেট রসিকের স্মৃতিতেও থাকবে না, রেডরোড থেকে ছায়াঘেরা কলকাতার ঘাস কোনোদিন জেনে যাবে না সৌরভ গাঙ্গুলি আসলে কোন মন্ত্রবলে বাঙালির আইকন হলেন!

সে আপনার নিজস্ব ললাটলিখন। সেই ভিনগ্রহের গ্যালাক্সিতে আপনিই পাঠিয়েছেন আপনার ভাগ্যরেখাকে। যে কক্ষপথে আমজনতার প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে মহাকাল, আমরা শুধু চেয়ে থাকতে পারি। বাঙালির ইতিহাসকে ফুটে উঠতে দেখি ক্রমশ উজ্জ্বল হতে থাকা নক্ষত্রপুঞ্জে, এ-ই কি কম প্রাপ্তি বলুন?

ভালো থাকবেন দাদা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link