ডিফেন্স লাইন, মরক্কোর এক্স ফ্যাক্টর

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, নেইমার, ভার্জিল ভ্যান ডাইকরা কোয়ার্টারে বিদায় নেওয়ার পর এমনিতেই একটা শূন্যতা কাজ করছে। একে এই বিশ্বকাপ তুমুল অনিশ্চয়তায় ভরা। শুরু থেকে ইকুয়েডরের ভ্যালেন্সিয়ার গোল হোক, কিংবা মরক্কোর এই অসাধারণ উত্থান – সাক্ষী থেকে গেল কাতার। যে কাতারে ভাবা হয়েছিল সেমিফাইনালে যাচ্ছেই ব্রাজিল, তাদের এ পরিসমাপ্তি। জাপানের স্পেন, জার্মানি – দুজনকে হারিয়ে দেওয়া। দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থে আপনাকে সুস্বাগতম।

ক্লাব ফুটবলে সারাবছর, সারা সিজন ধরে (বিশেষত ইউরোপে) যে ফুটবলটা খেলা হয় সেটা মূলত সিস্টেম নির্ভর। সিস্টেমের রূপান্তর ঘটছে উত্তরোত্তর। চোখের সামনে গড়ে ওঠা একটা সিস্টেমকে দমিয়ে উঠে আসছে আরেকটা সিস্টেম। যেমন মার্সেলো বিয়েলসার অধীনে খেলা ফুটবলটা ৯০ মিনিট ট্যাকটিক্যালি দৌড়ের খেলা। আধুনিক সিস্টেম অনুযায়ী ফাস্ট ফুটবল।

৪-১-৪-১ এ একটা ডিফেন্সিভ পিভট নিয়ে লো ব্লকে লোক বাড়ানো, আর অ্যাটাকের সময় দু’পাশে দুটো উইংয়ে ট্র্যাঙ্গল ফর্ম করে তার মধ্যে একটা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারকে পুট করা। এই সিস্টেমের পাল্টা সিস্টেম হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে স্পেনের তিকিতাকা, টোটাল ফুটবলের একটা অবিচ্ছেদ্য পার্ট। মাঝমাঠকে নিজের দিকে টেনে তার মধ্যে প্লেয়ার পজিশন চেঞ্জ করে করে পাস খেলবে ফাইনাল থার্ডের স্পেসকে লক্ষ্য করে।

এসব সিস্টেমের আধিক্য বর্তমান ফুটবলে এত বেশি যে তথাকথিত লাতিন আমেরিকা ফুটবল সংস্কৃতি এখন অনেকটাই পলিমাটি দিয়ে চাপা পড়ে থাকা ঝিনুকের মতো। কিঞ্চিৎ দেখা মিলছে, আর বেশিরভাগটাই চলে যাচ্ছে সিস্টেমের অন্তরালে।

২০২২ কাতার বিশ্বকাপ আদতে সিস্টেমের বিশ্বকাপ। ৩ থেকে ৫ জন সাবস্টিটিউটশন রুলটা ভ্যালিড হওয়ার পর যে সিস্টেমের পুজো আরও অনেক কার্যকর হয়ে দেখা দিয়েছে। ফর্মেশন অনুযায়ী নিজের দলের মধ্যে স্কোয়াড ডেপথ যার যত সুনিপুণ, সে তত ধনরাশির অধিকারী। আরেকটা জিনিস। ক্লাব ফুটবলে অ্যাটাক বেসড এবং মাঝমাঠে ক্যারি ফুটবল অধিকাংশ সময় খেলা হলেও, বিশ্বকাপের মতো নকআউট টুর্নামেন্ট জেতাবে ডিফেন্সিভ স্ট্রাকচার।

ব্রাজিলের ক্রোয়েশিয়ার কাছে কোয়ার্টারে ছিটকে যাওয়াই হোক, পর্তুগালের অমন টিমের মরক্কোর কাছে বিদায় নেওয়াই হোক – ডিফেন্স যার যত ভাল, সে তত পা ফেলবে সোনার কাপের দিকে। ব্রাজিল যেমন, ক্রোয়েশিয়ার অত ভাল ডিফেন্সের সামনে নেইমার-রিচার্লিসনের যুগলবন্দী কাজ করল না। রিচার্লিসন ঠিক নাম্বার নাইন নয়। গেমমেকার স্ট্রাইকার কিন্তু গোলটা চেনে ভাল।

উপরন্তু রবার্তো ফিরমিনো না থাকায় ও জেসুস চোটের জন্য ছিটকে যাওয়ায় নেইমার হোল্ডিংয়, ওয়ান-টু প্লে আর ভিশনের উপর নির্ভর করে রিচার্লিসনকে ৯ নাম্বার জার্সি দিয়ে একটা অপ্টিমাম সলিউশনে আসার চেষ্টাটা করেছিলেন তিতে, যেটা শেষে গিয়ে আর কাজ করল না। হাতে ডুয়াল অপশন ছিল না, এবং উইঙ্গাররা বারবার কাট ইন করেও গোলের দরজা খুলতে পারল না।

অন্যদিকে আর্জেন্টিনা কোয়ার্টারে ৩ ব্যাক সিস্টেমে দুটো পিভট নিয়ে খেলে জিতে বেরিয়ে গেল (রোমেরো-ওটামেন্ডির লো ব্লক নিয়ে কিঞ্চিৎ সন্দেহের জায়গা থেকেই যায়)। কিন্তু লো ব্লককে যদি কেউ দুর্দান্তভাবে ব্যবহার করে তো সেই ভদ্রলোকের নাম রেদরেগুই। ভদ্রলোক মরক্কোর কোচ হয়ে এসেছেন ২০২২-এরই ৩১শে অগস্ট এবং, আজ লিখেছেন ইতিহাস। মরক্কোর সাফল্য, মরক্কোর এই যাত্রাপথে রেদরেগুই যে ছবি এঁকে গেলেন তার ইতিহাস ফুটবলেরই একটা অংশ। যার সারমর্ম করলে শেকসপিয়ার মনে পড়ে— স্বর্গ, মর্ত্য, পাতালে এমন অনেক ঘটনা ঘটে হোরেশিও, যা তুমি কল্পনাও করতে পারো না।

রাউণ্ড অফ সিক্সটিনে লড়াইয়ে যে খেল দেখাল সবকটা টিম, তার মধ্যে মরক্কো দুম করে অনেকটা ওপরেই চলে এসেছে বলা যায়, এইভাবে স্পেনকে রুখে দেওয়ার জন্য। এটা আনস্পেক্টেড হলেও, প্রথমত নন-ফিজিক্যাল মোরাতা ছাড়া স্পেনের ফিনিশার নেই এবং মোরাতা নিজেও একজন মারকাটারি ফিনিশার নয় আর দ্বিতীয়ত, মরক্কো ডিফেন্সে আম্বুজা সিমেন্ট লাগিয়ে রাখবে কেউই তেমন আশা করেনি। তবু কানাডা ম্যাচটায় যদি ফিরে যাওয়া যায়, সেদিন ডানে পজিশন চেঞ্জার ডেভিসের অমন দৌড় আর স্কিল সত্বেও মাৎজারাউয়ির পায়ে রুখে গেছে।

মরক্কো ডিফেন্স করছে ডিফেন্স করতে হবে বলে নয়, রীতিমতো ট্যাকটিক্যালি ডিফেন্ড করে ম্যাচ বার করছে। হাকিমি, মাৎজারাউয়ি দুটো উইংব্যাক আর মাঝে একটু উপরে সাইস। সাইস ফাইনাল ট্যাকল করছে অ্যাটাকারকে একটু একটু করে খেলিয়ে বক্সের একটু আগে টেনে এনে, তার আগে নয়। যদি সাইস মিসফায়ার করে, গায়ে লেগে থাকছে অগার্ড। এই অগার্ডের ডিফেন্স কোয়ালিটির সাথে প্রথম পরিচয় রেঁনেতে, তারপর আফ্রিকান কাপ অফ নেশন্সে মরক্কোর প্রথম ম্যাচ ঘানার সাথে।

আন্দ্রে আয়ুকে একার হাতে রুখেছিল গোটা ম্যাচে, আর মিড লাইন বরাবর একটা থ্রু পাস খেলে লো ব্লকে জায়গা ফাঁকা করছিল। অগার্ড নিজেকে ধরে রেখেছে, এই বছর ওয়েস্ট হ্যামেও এসেছে রেঁনের সফর শেষ করে। প্লাস সাইস তো আছেই। বেলজিয়াম ম্যাচের প্রথম গোলটাই সাইসের। ৪-১-৪-১ এর একটা ইলাস্টিক ব্যান্ড শেপে প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ফিওরেন্তিনার আমরাবাত।

ফিওরেন্তিনার নামটা নিলাম কারণ আমরাবাত তুখোড় প্রতিভাবানা প্লেয়ার, ফিওরেন্তিনা বলে নজরে আসে না ততটা যতটা আসা উচিত। মরক্কো ডিফেন্স লাইনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শুরু ৩-৫-২ তে করে ঠিক নিজেদের ৪-৪-২ তে খুব তাড়াতাড়ি ট্র্যাকব্যাক করতে পারে। আরেকটু পেছনে ৫-৩-২। ফলে আপফ্রন্টে স্পেসই পাচ্ছে না অপোনেন্ট। যার ফল? ১০১৯টা পাস খেলেও স্পেনের কপালে ফক্কা!

ইনভার্টেড উইঙ্গার হিসেবে আগের সিজন ভাল যায়নি জিয়াচের। জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়েও ফিরে এসে কিন্তু কাপে জান দিয়ে খেলছে। আর এর গোটা ক্রেডিটটা ওয়ালিদ রেদরাগুইয়ের। দু’মাস আগে মরক্কোর দায়িত্ব নিয়ে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন। ৪-৩-৩ এ শুরু করে অ্যাটাকে ৩-৪-৩ হচ্ছে যাচ্ছেন।

দুই, বৌফল সাউদাম্পটনে খেলে গেছে। যে খেলাটা সাউদাম্পটনে শুরুর দিকে খেলতে পারেনি পেছনে ওয়েনিয়ামা, স্নাইডারল্যান আর ওয়ার্ড প্রস থাকাতেও, সেটা খেলতে পারছে কারণ ওনাহি বলে একটা নতুন ৮ নাম্বার পেয়েছে মরক্কো। যার লেফট চ্যানেল থেকে ভার্টিক্যাল পাসে ওয়াল খেলাটা বেশ সুন্দর। জিয়াচের সামনে ছোট্ট করে একটু স্পেস খুললেই সেখান থেকে ইনসাইড-আউটসাইড ডজে দৌড়ে গেল জিয়াচ। পাশে পেয়েছে ওনাহিকে, যে আপাতত ওয়ালটা একটা দুটো টাচে ভালই রেসপন্স দিচ্ছে।

দুই, বৌফল। যার ফার্স্ট টাচ বাচ্চে কি জান লে লেগা। ঘানা ম্যাচটায় লাস্ট মোমেন্টে বাজিমাত করে বেরিয়ে গেছিল। শেষ অব্দি আর টানতে পারেনি, কিন্তু এবারে আবার অধিক এনার্জি আর ইচ্ছে সহযোগে ফিরে এসেছে। ট্র্যাকব্যাকটা অত ভাল না হলেও পায়ে বল পড়লে পাস ঠিক খুঁজে নিচ্ছে আপে।

ট্যাকটিক্যালি, হিসেব অনুযায়ী খেলে আজ মরক্কো সেমিফাইনালের দোড়গোড়ায়। সামনে পাবে ফ্রান্সকে। রেদরেগুই জানেন, ফ্রান্সের একটা এমবাপে আছে। আচরাফ হাকিমির দিকেই তেড়ে আসতে চাইবে সে।

পিএসজিতে খেলার সুবাদে হাকিমি এমবাপের খেলার ধাঁচ সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল এবং সেই সুযোগকে যেনতেন প্রকারেণ কাজে লাগাতে চাইবেনই ধুরন্ধর ট্যাকটিশিয়ান ওয়ালিদ রেগুরাগুই। মরক্কোর এই লড়াইটা ফ্লুক নয়, পড়ে পাওয়া নয়। ওয়াইদাদ কাসাব্ল্যাঙ্কায় খেলা প্লেয়ারের সংখ্যা এই মূহূর্তে সবচেয়ে বেশি বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল পর্যায়ে।

এই ইতিহাস আগামি প্রজন্মকে হাতে ধরে পড়ানো উচিত। কোনওরকম নিয়মের তোয়াক্কা না করে। ম্যাচ ধরে ধরে একটা তৈরি ডিফেন্সিভ স্ট্রাকচারকে সামনে রেখে এমন খেলা দেখিয়ে গেল মরক্কো, যাদের থেকে আশা ছিশ খুব কম। বিশ্বকাপের ইতিহাস খুললে দেখা যায়, দোস হু ওনস দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ হু হ্যাড দ্য বেস্ট ডিফেন্সিভ স্ট্র্যাটেজি। খেয়াল করলে দেখা যাচ্ছে, ক্রোয়েশিয়া, মরক্কো, আর্জেন্টিনা – যে তিনটে টিম সেমিতে উঠল তাদের কারোর ডিফেন্স কাছাখোলা নয়। আর্জেন্টিনা কাল গোল খেয়ে গেছে বলে ওদের ডিফেন্স ধোপে টেকে না, এ মন্তব্য ভাসছে ইতিউতি।

কিন্তু না, লিসান্দ্রো-রোমেরো-ওটামেন্ডি প্লাস দুই উইংব্যাক আকুনা-মলিনা, পরে তাগ্লিয়াফিকো এবং মন্টিয়েল – দে আর ভেরি বেস্ট ইন দেয়ার পজিশন। এবং কোঅর্ডিনেশন। বিশ্বকাপ সেই জিতবে যার ডিফেন্স ভাল। অ্যাটাক দিয়ে গোল এলেও হাল হবে ব্রাজিলের মতোই। যেখানে অত সাধারণ একটা স্কোয়ার পাসকে আটকাতে ডিপ ডিফেন্সে কোনও সিডিএম দাঁড়িয়ে ছিল না।

আর সেই গেমপ্ল্যানকে মাঠে স্টেপ বাই স্টেপ অ্যাপ্লাই করে গেল রেদরেগুই অ্যান্ড কোং। রেদরেগুই দু’মাস আগে অ্যাপয়েন্ট হওয়া কোচ আর তারপরেই মরক্কো বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল! স্বপ্নের মতো, জাস্ট একটা স্বপ্নের মতো। ওই যে, চেষ্টা যারা করে তাদের সাহস আর জেদের অভাব হয় না।

আজকে সাইসকে পাবে না। ডিপ ডিফেন্সে ক্যাপ্টেন নেই। কতটা লড়বে জানা নেই কিন্তু লড়বে। আজ মন বলছে এমবাপে পজিশন চেঞ্জ করলেও খুব একটা লাভ হবে না। আঠার মতো শক্ত ডিফেন্স। জিরুর ফিনিশ তুলনায় অনেক বেটার হলেও, গোল তুলতে ব্যাপক খাটতে হবে। ব্যাপক। হ্যাটস অফ মরক্কো। টুপি খুলে অভিবাদন জানাই এই লড়াইকে। আগামীর দলিলে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে এই জেদ, এই সাহস, এই লড়াই।

আর আজ ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা কাপের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিশ্রমী ডিফেন্সিভ লাইনের বিরুদ্ধে নামতে চলেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link