মেঘের আড়ালে চাঁদের হাসি

টুর্নামেন্ট শুরুর আগে তাদের বিবেচনায় রাখেনি কেউ। উল্টো প্রথম ম্যাচের দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছিটকে যান দলের পোষ্টারবয় ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন। ফলশ্রুতিতে হেরে বসে নিজেদের প্রথম দুই ম্যাচ। এর আগে ইউরোর ইতিহাসে প্রথম দুই ম্যাচ হেরে পরবর্তী রাউন্ডে উঠতে পারেনি কোনো দলই।

নিজেদের শেষ ম্যাচে রাশিয়াকে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে তাই ইতিহাস গড়ে ডেনমার্ক। তাদের রূপকথার এই যাত্রা শেষ হয়নি সেখানেই, দ্বিতীয় রাউন্ডে বেলের ওয়েলশকে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত করে প্রথম দল হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে ডেনিশরা। ডলবার্গের জোড়া গোলের পাশাপাশি একটি করে গোল করেছেন ম্যোহেলে এবং ব্র‍্যাথওয়েট।

পুরো টুর্নামেন্টে দলগত ফুটবল দিয়ে ফুটবল বিশ্বকে মুগ্ধ করেছে দলটা। ব্যক্তিগত নৈপুন্যে নির্ভরশীল না হয়ে সবাই একত্রে চেষ্টা করেছেন দলকে এগিয়ে নিতে। আজকের ম্যাচের অন্যতম নায়ক ক্যাসপার ডলবার্গের কথাই ধরুন নাহ, নিয়মিত স্ট্রাইকার পৌলসেনের ইনজুরিতে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাকে নামান ড্যানিশ কোচ ক্যাসপার হাজুলমান্ড। অথচ ম্যাচে প্রথম দুই গোল করে দলকে এগিয়ে নেন নিসের এই স্ট্রাইকার।

আয়াক্সের বয়সভিত্তিক দল থেকে উঠে আসা ডলবার্গ আমস্টারডামের ইয়োহান ক্রুইফ অ্যারেনায় খেলেই বড় হয়েছেন। মাঠের প্রতিটি ঘাস চেনা ডলবার্গ প্রত্যাবর্তনের গল্পটা লিখলেন দারুণভাবেই। তার প্রথম গোলটার কথাই ধরুন নাহ, বক্সের বাইরে বাঁকানো শটে অনিন্দ্যসুন্দর এক গোল করলেন যাকে দেখে মনে হবে শিল্পীর আঁচড়ে আঁকা নিখুঁত শিল্পকর্ম। কিংবা এরিকসেনের বদলি হিসেবে দলে আসা তরুণ ডামসগার্ড।

অ্যাসিস্ট করার পাশাপাশি ডেনমার্কের আক্রমণ দানা বাঁধে তার পা থেকেই। ইতোমধ্যেই তার উপর চোখ পড়ে গেছে ইউরোপের বড় দলগুলোর। মাঝমাঠে পিয়েরে এমিল হয়বিয়া কিংবা মার্টিন ব্র‍্যাথওয়েটও খেলছেন দুর্দান্ত। হয়বিয়া তো রীতিমতো উড়ছেন, বড় বড় সব নাম পেছনে ফেলে চার অ্যাসিস্ট নিয়ে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টদাতা টটেনহ্যামের এই মিডফিল্ডার।

অন্যদিকে এবারের ইউরোর সবেচেয়ে বড় পাওয়া বোধহয় ডেনিশ দলনেতা সিমোন কায়ের। এরিকসেনের কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের পর প্রথম সিপিআর দেয়া এবং তার পরিবারকে সান্ত্বনা দেয়া, দলের মনোবল ফিরিয়ে এনে লড়াকু মনোভাব সৃষ্টি করার পাশাপাশি ডিফেন্সকে সামলে যাচ্ছেন একাই।

দলকে বেঁধেছেন এক সুঁতোয়, সবার কানে দিয়েছেন লড়াই করার মন্ত্র। তাকে যোগ্য সঙ্গ দিচ্ছেন জোয়াকিম ম্যোহেলে আর ক্রিস্টেনসেন। অন্যদিকে গোলবারে বরাবরই আস্থার প্রতীক ক্যাসপার স্মাইকেল, বাবার দেখানো পথে যিনি হাঁটছেন ঠিকভাবেই।

এবারের ইউরোতে ডেনমার্কের বড় শক্তি তাদের দর্শকেরা। গ্রুপর্বের প্রতিটি ম্যাচে কোপেনহেগেনের পার্কেন স্টেডিয়ামে ছিল তাদের সরব উপস্থিতি। ভেন্যু বদলে নেদারল্যান্ডস হলেও ডেনিশদের উপস্থিতি কমেনি, আমস্টারডামে গতকাল তাদের উপস্থিতি দেখে স্বাগতিক দল খেলছে ভেবে ভুল করে বসবে সবাই। পুরো গ্যালারি মাতিয়ে রেখেছিলেন লাল জার্সিতে, কিছুক্ষণ পরপর গোল হয়েছে আর দর্শকেরা ফেটে পড়েছেন বুনো উল্লাসে। এমনকি মাঠে উপস্থিত ছিলেন তাদের প্রধানমন্ত্রীও, মাঝে মাঝেই ক্যামেরায় ধরা পড়ছিল সদাহাস্য ফেদেরিক্সেনের মুখটা।

গত ইউরোতে সবাইকে চমকে দিয়ে সেমিফাইনাল খেলেছিল গ্যারেথ বেল-অ্যারন রামসিদের ওয়েলস। এবার সেরকম প্রত্যাশাই ছিল তাদের কাছে, কিন্তু ডেনমার্কের বিপক্ষে গতকাল বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ গড়তে পারেনি তারা। মাঝের কয়েক মুহূর্ত বাদে ডেনিশ কিপার স্মাইকেল বলতে গেলে অলস সময় কাটিয়েছেন। উল্টো তাদের ডিফেন্স করেছে হাস্যকর সব ভুল, দ্বিতীয় গোলের কথাই ধরুন নাহ, ব্র‍্যাথওয়েটের ক্রস ক্লিয়ার করতে গিয়ে তুলে দেন ডলবার্গের পায়ে, সেখানে থেকে গোল মিস করাই কষ্টসাধ্য ছিল তার জন্য। ফলশ্রুতিতে এবার দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বাড়ি ফিরতে হলো তাদের।

রূপকথার গল্পের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন ছিলেন ডেনমার্কের। ইউরো আর ডেনমার্কের রূপকথা বোধহয় তারই লেখা, নইলে প্রতিবার ছিটকে যাবার আগ মুহূর্তেই কেন মরণকামড় দেবে ডেনমার্ক। ১৯৯২ সালে টুর্নামেন্ট খেলারই কথা ছিল নাহ তাদের, অথচ গোথেনবার্গে শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছিল তারাই। এবারো বাদ পড়ে যাবার সময়ই ঠিক ঘুরে দাঁডিয়ে চলে গেছে কোয়ার্টার ফাইনালে। সেখানে তাদের প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডস কিংবা চেক প্রজাতন্ত্র।

আরেকটা কাকতালীয় ব্যাপার বলে শেষ করি, ১৯৯২ ইউরোতে ডেনমার্ক খেলেছিল তাদের সেরা তারকা মাইকেল লাউড্রপকে ছাড়াই। এবারো প্রথম ম্যাচেই ছিটকে গেছেন তাঁদের সেরা তারকা এরিকসেন। তাহলে কি আবারো রচিত হবে ডেনিশ রূপকথা?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link