দিদিয়ের দেশ্যম, সেজদার উত্থান

দিদিয়ের দেশ্যমকে আমার পছন্দ ছিল না। দেশ্যম হচ্ছে বাড়ির সেই সেজদা, যিনি এক আকাশ প্রতিভা নিয়েও, প্রশান্ত মহাসাগরের সমান মেধা নিয়েও কখনও সাধারণ সরকারী আমলাগিরি ছাড়া কিছু করেননি। চাইলেই হয়তো আইনস্টাইন থেকে রবীন্দ্রনাথ সবাইকে একহাটে বেচে আরেক হাটে কিনে নিতে পারতেন লাভ রেখে, কিন্তু অতিরিক্ত পরিশ্রম করবেন না, তাই দশটা পাঁচটার চাকরিতেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

মরক্কো এযাবৎ টুর্নামেন্ট ফুটবলে আফ্রিকার সেরা দল। কোচ ওয়ালিদ রেগুরাগুই খুব সামান্য দিন দলটাকে হাতে পেয়েই এক সূত্রে বেঁধে ফেলেছেন। যে হাকিম জিয়েশ আর কখনও মরক্কোর হয়ে খেলবেন না ঘোষণা করেছিলেন, তাকে দিয়ে পর্যন্ত প্রাণপাত করিয়েছেন।

আগেরদিনই লিখলাম বোনো, হাকিমি আর কিছুটা জিয়েশ ছাড়া প্রায় সকলেই মাঝারিমানের দলে খেলেন। কিন্তু একসঙ্গে লাল সবুজ পরলেই বিশ্বকাপের ময়দানে সোনালি কেশরের সিংহ।

দেশঁ শুরুতেই দেখেছেন যে এই বিশ্বকাপে ধারাবাহিক ভালো খেলে আসা র‍্যাবিয়ঁকে পাচ্ছেন না। আর বাঁ দিক দিয়ে উপমেকানো আর থিও, আগের ইংল্যন্ড ম্যাচে বেশ নড়বড়ে ছিলেন। তাই ডিপ ডিফেন্সে উপমেকানোর জায়গায় ইব্রাহিম কানাতে আর র‍্যাবিয়টের জায়গায় ফিজিক্যাল একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসাবে মোনাকোর ইউসুফ ফফানা। আর চৌমেনিকে ৬ নম্বর পজিশন থেকে একটু উপরে তুলে রাখলেন। ফফানার জায়গায় তিনি কামাভিঙ্গা অথবা গুয়েন্ডোজিকেও নামাতে পারতেন। কিন্তু আসল পরিকল্পনায় ফাঁক থেকে যেত।

তা পরিকল্পনাটা কী? দেশঁ দেখে নিয়েছেন যে সারা টুর্নামেন্টের ৩২টা দলের মধ্যে বল পজেশনে মরক্কো একত্রিশতম ৩২% বল পজেশন নিয়ে। মরক্কোর শক্তপোক্ত ডিফেন্স, রাবারব্যান্ডের মতো একতা আর বাধনতোড় গতি। সমস্যা হল এন নাসিরি ভালো ফরোয়ার্ড হলেও তিনি হোল্ডিং প্লেতে যতটা দড় গোল করায় নয়। অর্থাৎ ভালো স্কোরার নেই। সেখানে ফ্রান্সের আছে একটা জিরু, একটা এমবাপ্পে।

দেশঁ প্রস্তুতি নিলেন, মরক্কোর হাতে পজেশন তুলে দিতে। বাঁদিক, যেখানে এমব্যাপে ডিফেন্ড করতে নামবেন না সেখানে থিও হার্নান্ডেজকে যা তে একা পড়তে না হয়, তাই ফফানাকে রাখলেন। ইব্রাহিম কানাতে ডিফেন্সিভ সংগঠনে দারুণ, কিন্তু শূন্যে অতটা ভালো না। সেই ঘাটতি মেটাবেন ফফানা। আক্রমণটা শুরুতেই দানা বাঁধল ডানদিকে। অর্থাৎ ওভারলোডটাই বদলে দিলেন।

অভিমুখ থিও, কিলিয়ান না হয়ে হয়ে গেল ডেম্বেলে, গ্রিজমান। কিলিয়ান তখন ইনভার্ট করে ঢুকে এসেছেন। জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে তিনচারজনকে ব্যস্ত রাখলেন, ডিফ্লেকশনটা প্রায় কনুইয়ের উচ্চতায় উঠলে ঠাণ্ডা মাথায় সঠিক টেকনিকে থিও বলটা গোলে রাখলেন। বোনো হয়তো একটু আগে বেরতে পারতেন, কিন্তু কিলিয়ান এমব্যাপে বা আর্লিং হাল্যান্ড নামগুলো আঠেরো গজের বক্সে ঢুকলেই ত্রাহিরব ওঠে আর দশ গজে ঢুকলে তো কথাই নেই।

পাঁচ মিনিটে গোল তুলে নিয়ে আবার অপেক্ষা। বাঁদিকে কিলিয়ানকে বলা আছে চুপচাপ সেন্টার লাইনের কোণে অপেক্ষা করতে। প্রয়োজনে হাকিমির সামনে শুধু শরীরটা রাখতে। হাকিমি বাইরে দিকে সরবেন আর জিয়েশ ইনভার্ট করবেন দুজনকে আরামসে পকেটে পুরে ফেললেন ফফানা আর থিও। থিওর কালকের পারফরম্যান্সের পর তাঁকে তাঁর দাদা লুকাসের সঙ্গে একাসনে বসানোই যায়।

বাঁদিকে অবিচল কুন্ডে আর এই বিশ্বকাপের নীরব নায়ক রাফায়েল ভারান তো রয়েইছেন। বৌফল দাঁত ফোটাতে পারছেন না।

মরক্কো শুরু করেছিল ৫-৪-১এ কিন্তু সাইস বেশিক্ষণ টানতে পারলেন না। এতে কিন্তু মরক্কোর ক্ষতি হল না। ৫-৪-১এ সহজেই আমরাবাতকে প্রেস করছিলেন জিরু। সেই সময় উনাহি নেমে এলে গ্রিজমান ধরছিলেন তাঁকে। সাইস উঠতে মরক্কো সুবিধাজনক ৪-১-৪-১এ চলে গেল। জিরু প্রেস করছেন, আমরাবাত হাফ স্পেসে উনাহিকে পেতে শুরু করলেন।

ততক্ষণে বাঁদিকে মাজরাউইয়ের জায়গায় আতিয়াত-আলাহ নেমে গেছেন। তাঁর অবস্থান একটু উপরে। আমরাবাত তাঁকেও ফালক্রাম করে ত্রিভুজ গঠন করছেন। বৌফল আর জিয়াচ ইনভার্ট করে বল নিচ্ছেন। প্রচুর বল, কিন্তু বক্সের ভিতর মরক্কোর সিদ্ধান্ত নেবার অক্ষমতা ভোগাচ্ছে।

শেষ কোয়ার্টার। দেশঁ শেষ চালটা চাললেন। দেখলেন যে কিলিয়ান কাউন্টার অ্যাটাকে উঠে যাচ্ছেন বটে কিন্তু জিরুকে গতিতে সঙ্গে পাচ্ছেন না। অপর দিকে ডেম্বেলেও ক্রমাগত ওঠানামা করে ক্লান্ত। দুটো ফ্রেশ লেগসদের নামালেন। এক লিলিয়াম থুরামের ছেলে মার্কাস আর ডেম্বেলের জায়গায় এনকুঙ্কু চোট পাওয়ায় আইন্ট্র্যাক্ট ফ্র্যাঙ্কফুর্টের যে বাচ্চা উইঙ্গারটিকে দলে নিয়েছিলেন, সেই র‍্যান্ডাল কোলো মুয়ানি। মার্কাসকে ঠেলে দিলেন বাঁদিকে, কিলিয়ান দৌড় শুরু করবেন মাঝখান থেকে।

ফলে আমরাবাত, যিনি এ পর্যন্ত একইদিকে প্রয়োজনে নেমে এসে গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারসেপশন করছেন তিনি একটু বিভ্রান্ত হলেন। দ্বিতীয় গোলটার সময় দেখবেন থুরাম যখন কিলিয়ানকে দিলেন তখন কিলিয়ান আমরাবতকে ডান দিকে রেখেছেন, ড্রিবলে না গিয়ে বল রাখলেন বাঁদিকে থুরামের জন্য। নিজে জায়গা নিলেন পেনাল্টি বক্সের ঠিক মাথায়। থুরাম এগিয়ে গিয়ে যখন বল ফেরত দিলেন তখন আমরাবত অফ ব্যালেন্স।

ট্যাকেল করতে গিয়েও ছেড়ে দিলেন কারণ কিলিয়ানের চোরাগতিতে পা লাগালে সাক্ষাত পেনাল্টি। দুটো এদিক ওদিক, দুটো ড্রিবল আর তারপর একটা শট। কপাল বলুন আর ক্যালকুলেশন, বলটা এজালজাউলির পায়ের নিচে লেগে দিক পরিবর্তন করল। আর মাঠে ঢোকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাজা গতিতে ট্যাপ ইন তুলে চলে গেলেন কোলো মুয়ানি।

আরেকজনের কথাও বলতে হয়। হুগো লরিস এই বিশ্বকাপের অধিনায়কদের মধ্যে একমাত্র একজনেরই ওই বাইশ ক্যারাটের ট্রফিটা তোলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু লরিসের বয়স হয়েছে, সামান্য হলেও। তাই বারবার তারকাখচিত ফ্রান্সের একমাত্র দুর্বল শৃঙ্খল বলা হচ্ছিল তাঁকে। কিন্তু ইংল্যন্ড ম্যাচ এবং কালকের মরক্কো ম্যাচ সঠিক সময়ে পাহাড়সম দাঁড়িয়ে গিয়ে আবার মনে করালেন যে বিশ্বমঞ্চে অভিজ্ঞতার কোনও বিকল্প নেই।

মরক্কো বেরিয়ে গেল বটে, কিন্তু তাদের যাত্রাপথ এবারের বিশ্বকাপটাকে এক অমল আলো দিয়ে গেল। বিশ্বকাপের শুরুতে কেউ ধরেনি। আফ্রিকা থেকে সবাই বলেছে সেনেগাল, ঘানা, এমনকি তিউনিশিয়ার নাম। মরক্কো বলতে সকলেই বলেছেন আচরাফ হাকিমি অথবা প্রাক্তন আয়াক্স হাকিম জিয়েশের নাম। বাকিদের নাম নিয়ে কেউই আলোচনা করেনি।

এই মরক্কো কিন্তু ছোট দল হিসাবে ভাল পারফর্ম করল না। তারা একটা আশার আলো জাগালো, একটা নতুন ঐতিহ্যের খবর দিল। এবং খেলা থেকে পরিষ্কার, তরুণ ও প্রবীণদের নিয়ে এই মরক্কোকে শুধুমাত্র স্বর্ণপ্রজন্মের তকমায় একটা সময়ে আটকে রাখা যাবে না।

আফ্রিকা জাগছে, বিশ্বফুটবলে প্রথম চমকে দেওয়া ক্যামেরুন বা আগুন ধরিয়ে দেওয়া নাইজিরিয়ার সূত্র ধরে সেনেগাল, আইভরি কোস্ট আর উত্তর আফ্রিকার দলগুলি। ওই পাঁচটা বিশ্বকাপ স্পট দিয়ে শুধুমাত্র আর বঞ্চিত করে রাখা যাবে না তাদের।

আর দিদিয়ের দেশ্যম। খুব ভালো করেই জানেন যে ঘাড়ের কাছে বহুদিন ধরে শিকার ধরার জন্য অপেক্ষায় জিনেদিন জিদান। একটা ব্যর্থতা বিশ্বের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক, যাঁর কোচ হিসাবেও কাপ আছে, তার লেগ্যাসি বা ঐতিহ্যকে ছুঁড়ে ফেলতে কেউ কার্পণ্য করবে না। বিশ্বকাপ শুরু হবার আগে বা শুরু থেকেই একে একে পল পগবা, এনগোলো কন্তে, প্রেসনেল কিম্পেম্বে, ব্যালন ডি’অর করিম বেঞ্জিমা, শেষে লুকাস হার্নান্ডেজ কক্ষচ্যুত হলেন। কিন্তু প্রতিভাধর ফ্রান্সের এক এক করে পাঁজরা খসে গেলেও দিদিয়ের দেশ্যমকে লক্ষ্যচ্যুত করা গেল না।

ফাইনালে রবিবার মুখোমুখি হচ্ছেন এই বিশ্বকাপের সেরা দুই তারকা দিদিয়ের দেশ্যম এবং লিওনেল স্কালোনি। নশ্বর মানুষ না হয় কিলিয়ান এম্ব্যাপে এবং লিওনেল মেসিদের নিয়ে নাচানাচি করুক। ফুটবল দেবতা কিন্তু ঠিক জানেন যে দেশ্যম ও স্কালোনি ছাড়া ফাইনালটা পরিযায়ী শিল্ডই হয়ে যাবে। ইউরোপের সম্মান আর লাতিন জেদের লড়াই। দেখা যাক কী পরিণতি হয় তাঁর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link