একেবারেই টালমাটাল পরিস্থিতি। কোন হিসেব কষেও মিলছে না পরিত্রাণ। গেল তিন বছরের পাঁচজন কোচ এসেছেন ডাগ আউটে। আবার চলেও গেছেন। কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছিলো না। তারপর এক সাহসী কিংবা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো৷ দলের বেহাল দশা থেকে পরিত্রাণের জন্যে কোচের দায়িত্বটা দেওয়া হবে সাবেক এক খেলোয়াড়কে। ভাবা অনুযায়ী কাজ করে ফেললো অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ।
এক দশক, অর্থাৎ বছর দশ আগে এমনই এক পরিস্থিতিতে স্প্যানিশ লা লিগার বর্তমানের পরাশক্তি দল অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কোচের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন সাবেক অ্যাটলেটিকো তারকা ডিয়েগো সিমিওনে। তিনি যখন এলেন তখন দলের অবস্থা বেশ বেগতিক। লিগ টেবিলের দশম স্থানে অবস্থান করছে তখন মাদ্রিদের অন্যতম সেরা ক্লাবটি। এরই সাথে দল থেকে ততদিনে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে পাড়ি জমিয়েছেন তৎকালীন তরুণ তারকা সার্জিও অ্যাগুয়েরো ও ডেভিড ডি গিয়া। সিমিওনের কাছে বিকল্প খুব সীমিত। তবে কিছু একটা তাঁকে করে দেখাতেই হতো।
কি করবেন সিমিওনি? দলের কোন দিকটা আগে সামাল দেবেন? কোথা থেকে শুরু করবেন? এসব কিছুই চিন্তা করতে তিনি আগে নজড় দিলেন তাঁর রক্ষণে। বিশ্ব নন্দিত কোচ হোসে মরিনহো একবার বলেছিলেন, ‘আক্রমণ আপনাকে ম্যাচ জেতায় আর রক্ষণ আপনাকে জেতাবে শিরোপা।’
সেই মূলমন্ত্রই হয়ত সিমিওনেও নিজের মধ্যে ধারণ করতেন৷ তাই তিনি চেলসি থেকে লোনে আসা গোলকিপার থিবো কর্তোয়া ও উরুগুয়ের ডিফেন্ডার ডিয়েগো গডিনকে নিয়ে রক্ষণ আগলে রাখার রণকৌশল এঁকে ফেললেন। তাতে বেশ কাজও হলো। সিমিওনে দায়িত্ব পাওয়ার পরবর্তী ছয় ম্যাচের ছয়টিতেই ক্লিনশিট।
সমর্থকদের দ্বারা সমাদৃত হতে শুরু করলেন সিমিওনি। সমর্থকরাও নতুন করে স্বপ্ন দিয়ে বুনন করতে লাগলেন লাল-সাদা জার্সি। সেই লাল-সাদা জার্সির জন্যে যে কোন মূল্যে জয় ছিনিয়ে আনতেই হবে। এমন এক মন্ত্র ছড়িয়ে দিলেন সিমিওনি। দলও সেই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে নিজেদের শেষটুকু উজাড় করে দিতে শুরু করলো। সেই প্রাণ বিসর্জন দেওয়া পারফর্মেন্সের ফলাফলও পেলো অ্যাটলেটিকো। সিমিওনি আসার ছয় মাসের মাথায় ক্লাবটি উইয়েফা ইউরোপা কাপ জিতে নেয়। ফাইনালে তারা হারায় অ্যাটলেটিকো বিলবাওকে ৩-০ গোলে হারিয়ে৷ এ যেন ছিলো কেবলই শুরু।
নতুন মোমেন্টামে ২০১৩/১৪ মৌসুমে তো রীতিমত শিরোপার লড়াই শেষ ম্যাচ অবধি টেনে নিয়ে গিয়েছিলো সিমিওনির দল৷ স্বল্প বাজেটে বানানো এক দল একেবারে সমানে সমান লড়াই করেছিলো বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদের মতো অর্থের ছড়াছড়ি হওয়া ক্লাব গুলোর বিপক্ষে। কি দারুণ লড়াই! সেই লড়াইয়ের ঝাঁজ বাড়িয়ে দিলো লিগের শেষ ম্যাচ। মুখোমুখি দুই শিরোপা প্রত্যাশি বার্সেলোনা ও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। অ্যাটলেটিকোর যেখানে ড্র-তেই মিলবে শিরোপা সেখানে বার্সেলোনার সমীকরণে জয়ের বিকল্প নেই৷
ক্যাম্প ন্যু বার্সার ডেরায় বার্সার বিপক্ষে ড্র নিয়ে ফেরাও তো চাট্টিখানি কথা না। তা বুঝিয়েও দিলেন স্বাগতিক খেলোয়াড় অ্যালেক্সিস সানচেজ। তবে সে যাত্রায় হেডারে গোল আদায় করে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে শিরোপা এনে দেন গোদিন। ১৯৯৬ এর পর আবারো লাল-সাদা জার্সিধারীরা দেখা পেলো লিগ শিরোপার৷ পেছনের কারিগর সেই ডিয়েগো সিমিওনি ও তাঁর রক্ষণ সামলাও নীতি।
মাদ্রিদের কর্মজীবী মানুষদের ক্লাব বলেই বিবেচিত হওয়া অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে এক নতুন দিনের পথ দেখাতে শুরু করেন। অ্যাটলেটিকোর কোচিং ক্যারিয়ারের দশটি বছরে সিমিওনি ক্লাবটিকে প্রত্যেকটি শিরোপা জয়ের জন্যে শেষ অবধি লড়াই করিয়েছেন৷ দু’বার দলটিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে নিয়ে গিয়েছেন উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল অবধি। তাছড়া গত মৌসুমের লিগ শিরোপাও যুক্ত হয়েছে সিমিওনির অর্জনের ক্যাবিনেটে।
এর পাশাপাশি গেলো এক দশকে লিগে শীর্ষ তিনে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের অবস্থান যেন ছিলো সুনিশ্চিত। এর ফলে ক্লাবটিতে যেই বাজেট সংকট ছিল। তার অনেকটাই দূর হয়ে গেছে। এমনকি ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ অর্থের বিনিময়ে দলে ভিড়িয়েছে পর্তুগালের উদীয়মান তারকা জোয়াও ফেলিক্সকে। শহরের জীর্ণ স্থানের স্টেডিয়াম থেকে আজ তাদের ঘরের মাঠ আধুনিকতায় পরিপূর্ণ ওয়ান্ডা মেট্রোপলিটানো। এসব কিছুর কৃতীত্ব তো সিমিওনি পাবেন। তাঁরই তো পাওয়া উচিৎ। তারকা খেলোয়াড়, কোচ হয়ে দলকে বানালেন ইউরোপীয় ফুটবল অন্যতম তারকা।
তবে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে নতুন এক দশকে পদার্পণ করতে যাওয়া ডিয়েগো সিমিওনে পড়েছেন আত্মপরিচয় সংকটে। অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, তিনি এমন এক পরিস্থিতির মধ্যেই রয়েছেন। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ক্লাবকে এতো জৌলুশ, এত অর্থকড়ি এনে দেওয়া কোচ কেন পড়বেন পরিচয় সংকটে? এ কেমন কথা? পরিষ্কার করে বলি।
প্রধান সমস্যা যেটা হচ্ছে তা হলো আইডিওলজিকাল। ক্লাবের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের আদর্শ ছিলো পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়াই। যেহেতু অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকে মনে করেন ক্লাবটি কর্মজীবী মানুষদের ক্লাব। যারা কিনা হাজার শোষণ-বঞ্ছনার স্বীকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত এবং যারা খুব সহজে কখনোই কিছু পাননা। তাদেরকে প্রতিটা জিনিসের জন্যে করতে হয় লড়াই। সেই প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ক্লাবটি এই মতাদর্শেই ভর করে এসেছে এই অবধি। ডিয়েগো সিমিওনি যখন খেলতেন তখনও ঠিক এই আদর্শে বুদ ছিলো পুরো দল। তিনি যখন কোচ হিসেবে এলেন দলে তখনও চিত্রই ছিল ঠিক একই।
কিন্তু বর্তমান দলের মাঝে এই মতাদর্শের ঘাটতির উদয় হতে শুরু করেছে৷ কেননা মিলিয়ন ইউরোর এক একজন মেগাস্টার খেলছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাবের আধুনিকতম স্টেডিয়ামে। তাদের মাঝে প্রত্যেকটি জয়ের জন্যে নিজের সবটুকু দিয়ে লড়ে যাওয়ার প্রেরণার পার্থক্য যেন স্পষ্ট। তবুও সিমিওনি নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে অনড় থাকতে চাইছেন ক্লাবের প্রাচীনতম মতাদর্শে।
তবে সময়ের সাথে সিমিওনে চেষ্টা করছেন দলের খেলোয়াড়দের সাথে তাল মেলাতে। দলে এখন ভরপুর আক্রমণভাগের তারকাদের দিয়ে। সুতরাং সিমিওনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলের দখল বাড়িয়ে আক্রমণে থাকা তারকাদের পূর্ণ ব্যবহার করতে৷ কিন্তু সমস্যাটা বাঁধছে অন্য জায়গায়। সিমিওনি তাঁর পূর্বের সেই রণকৌশল আগে রক্ষণ সামাল দাও থেকে পুরোপুরি বেড়িয়ে আসতে পারছেন না। এর ফলে যা হচ্ছে দলকে মাঠে প্রায়ই কিংকর্তব্যবিমুঢ় আচরণ করতে দেখা যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে ম্যাচের ফলাফল চলে যাচ্ছে বিপক্ষ দলের কাছে।
দীর্ঘ দশ বছরে পরপর তিনটি ম্যাচে হারের স্বাদ পেলেন৷ লিগ শিরোপা ডিফেন্ড করার আশাও ইতোমধ্যে ক্ষীণ হতে শুরু করেছে। মোদ্দাকথা সিমিওনে রয়েছেন উভয় সংকটে। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ শিবিরে আরো একটি দশক শুরু করতে যাওয়া সিমিওনি একটি মামুলি দলকে বানিয়েছেন অন্যতম বড় দল।
এখন এই বড় দলকে পুরোনো কৌশলেও মাঠের খেলায় খেলাতে পারছেন না। আবার নতুন নিয়মকানুন মেনে দলকে জয়ও এনে দিতে পারছেন না। এখন সিমিওনেকেই দলের এই সংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। তিনি পারবেন কিনা তা সময়ই বলে দেবে৷