সময়টা ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সব খানেই মার খাচ্ছে পাকিস্তানিরা। অন্যদিকে, ক্রিকেট বিশ্বেও চলছে ক্যারিবিয়ান দাপট, গ্যারি সোবার্সের দলের রাজত্ব পুরো বিশ্বজুড়ে। এমন সময় অজিত ওয়াদেকারের নেতৃত্বাধীন ভারত গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। কিংস্টনে প্রথম টেস্টে ব্যাট করতে নেমে ভ্যানবার্ন হোল্ডার এবং গ্রেসন শিলিংফোর্ডের তোপে পড়ে ভারতীয়রা।
দুরন্ত গতির সাথে পাঁজর বরাবর বলে চোখে মুখে সর্ষেফুল দেখছিলেন ভারতীয়রা। তিনি যখন নামলেন ততক্ষণে ফিরে গিয়েছেন দুই ওপেনার। তিন অংকের ঘরে পৌঁছানোর আগেই দেখলেন আরো তিন সতীর্থের নীরব প্রস্থান। শুরু করলেন পাল্টা আক্রমণ, হোল্ডারের শর্ট বল পুল করে পাঠালেন মাঠের বাইরে। প্রথমে একনাথ সোলকারকে নিয়ে গড়লেন ১৭৬ রানের জুটি।
সোলকার আউট হলে লোয়ার অর্ডারদের নিয়ে দলকে এনে দিলেন লড়াই করার মতো স্কোর। বিদেশের মাটিতে প্রথম ভারতীয় হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরি করে যখন সাজ ঘরে ফিরছেন ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে কিংস্টনের দর্শকেরা। দলের মোট রানের অর্ধেকের বেশি ছিল তারই। অকুতোভয় এই ওপেনারের নাম দিলীপ সারদেশাই।
১৯৪০ সালে গোয়ার মারগাঁওতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। গোয়া তখন পর্তুগালের অধীনে ছিল। গোয়ার প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার ছিলেন তিনি। ছোটবেলাতেই তার পরিবার মুম্বাইতে চলে আসে। অন্য সব ভারতীয় ক্রিকেটারদের মতো তিনি ছোটবেলাতেই ক্রিকেটের প্রেমে পড়েননি। জীবনের প্রথম ক্রিকেট বলে ম্যাচ খেলেন ১৭ বছর বয়সে এসে।
কিন্তু, প্রকৃতি প্রদত্ত প্রতিভা এবং পরিশ্রমের কারণে মাত্র চার বছরের মাঝেই জায়গা করে নেন জাতীয় দলে। রোহিনটন বারিয়া টুর্নামেন্টে ভালো খেলার সুবাদে ডাক পান ভারত বিশ্ববিদ্যালয় দলে। তাদের হয়েই পাকিস্থানের বিপক্ষে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তার। প্রথম ম্যাচে ফজল মাহমুদের মতো বোলারকে সামলে খেলেন ৮৭ রানের ঝকঝকে এক ইনিংস। জানান দেন নতুন তারকার আর্বিভাব ঘটেছে ভারতীয় ক্রিকেটে।
১৯৬১ সালে কানপুরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক ঘটে তার। প্রথম ম্যাচেই দারুণ শুরু করলেও ইনিংস বড় করতে পারেননি। পরের বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ওয়েস হল-চার্লি গ্রিফিথদের মতো পেসারদের সামলে খেলেন ৯১ রানের দারুণ এক ইনিংস। মাঠ এবং মাঠের বাইরে সারদেশাই ছিলেন মজার এক চরিত্র।
একবার অ্যাডিলেডে চার রান বাঁচাতে গিয়ে যখন দেখলেন ব্যাটসম্যান দৌড়ে পাঁচ রান নিয়ে নিচ্ছে তখন তিনি করেন অদ্ভুত এক কান্ড। নিজে লাথি দিয়ে বলকে পার করে দিলেন বাউন্ডারির সীমানা! ক্রিকেট ইতিহাসে ফিল্ডার নিজে বলকে সীমানার বাইরে পাঠাচ্ছে এমন দৃশ্য বোধহয় আর কখনো দেখা যাবে না।
আবার একবার সতীর্থ সেলিম দুরানিকে ফোন দিয়ে দিয়ে ভক্ত পরিচয়ে লবিতে দেখা করতে চান। বেচারা দুরানি সেজেগুজে লবিতে গিয়ে দেখেন কেউ নেই, বারবার খুঁজেও যখন দুরানি কাউকে না পেয়ে গোমড়ামুখে বসে আছেন তখন হাসতে হাসতে আবির্ভাব হয় সারদেশাইয়ের। তাকে হাসতে দেখেই ঘটনা বুঝতে পেরে হেসে ফেলেন দুরানি নিজেও। হাসতে এবং হাসাতে এতটাই পারদর্শী ছিলেন তিনি।
১৯৬৭ সালে ফর্মহীনতার কারণে দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। কিন্তু যার জন্ম হয়েছে ব্যাট হাতে শাসন করার জন্য তিনি কি করে দলের বাইরে থাকেন। কঠোর পরিশ্রম করে দলে ফিরে আসেন তিন বছর পর। আর কি রাজসিক প্রত্যাবর্তন তার! ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচে তিন সেঞ্চুরিতে করেন ৬৪২ রান। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন শেষও করেন তাদের বিপক্ষে।
পরের বছরই দিল্লীতে ইংরেজদের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে দীর্ঘ এক যুগের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি টানেন তিনি। ভারতের হয়ে ৩০ টেস্টে পাঁচ শতক এবং নয় অর্ধ-শতকে সংগ্রহ করেন ২,০০১ রান। পরবর্তীতে তার ছেলে রাজদ্বীপ সারদেশাইও খেলেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট।
ক্রিকেটকে ভারত উপহার দিয়েছে অসাধারণ সব ব্যাটসম্যান। সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকা করলে হয়তো থাকবেন না সারদেশাই। কিন্তু সবাই তাকে মনে রাখবে ভারতীয় ক্রিকেটের সেই শুরুর দিকের অকুতোভয় এক ওপেনারকে, নিজের দিনে প্রতিপক্ষকে যিনি বিন্দুমাত্র সুযোগ দিতেন না। মনে রাখবে সেই মানুষটাকে যিনি মাতিয়ে রাখতেন নিজের আশেপাশের সবাইকে।