স্বপ্ন দেখানো গ্লাভসজোড়া

বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে সেরা গোলরক্ষক কে? লাল-সবুজের ফুটবল সম্পর্কে যাদের ধারনা আছে তারাই এমন প্রশ্নে বলতে পারবে আমিনুল হকের নাম। দেশসেরা এই গোলকরক্ষক অবসর নিয়েছেন আরো আগেই।

বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে সেরা গোলরক্ষক কে? লাল-সবুজের ফুটবল সম্পর্কে যাদের ধারনা আছে তারাই এমন প্রশ্নে বলতে পারবে আমিনুল হকের নাম। দেশসেরা এই গোলকরক্ষক অবসর নিয়েছেন আরো আগেই। আমিনুল-পরবর্তী জাতীয় দলের গোলপোস্টের নিচে মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা হয়েছে। অনেক গোলরক্ষক এসেছেন, কিন্তু দলে থিতু হতে পারেননি কেউই।

অবশেষে এমন মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা শেষ হয়েছে, লাল-সবুজের জার্সিতে আগমন ঘটেছে আনিসুর রহমান জিকো’র। নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে ইতোমধ্যে এই গোলরক্ষক জায়গা করে নিয়েছেন দেশের ফুটবলভক্তদের হৃদয়ে।

১৯৯৭ সালের ১০ আগস্ট কক্সবাজারে জন্মগ্রহণ করেন আনিসুর রহমান জিকো। কক্সবাজারের ডুলাহাজারার বালুচর গ্রামে বাড়ি আনিসুরের। জিকোর ফুটবলের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে কক্সবাজারের ডুলহাজারা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় মাঠে। ছোটবেলায় একটু স্বাস্থ্যবান ছিলেন বলে বড় ভাইয়েরা কিছুটা জোর করেই গোলপোস্টে দাঁড় করিয়ে রাখতেন আনিসুরকে।

এভাবেই গোলকিপিংয়ের শুরু আনিসুর রহমান জিকোর। এলাকার মাঠে নিজের গোলকিপিং দিয়েই নজর কাড়েন শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের স্ট্রাইকার নূরুল আবসারের। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই নিয়মিত অনুশীলন শুরু করেন জিকো। অবশ্য ছেলে ফুটবল খেলুক সে ব্যাপারে সমর্থন ছিল না জিকোর বাবার।

তাই কক্সবাজারে কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটনের অধীনে অনূর্ধ্ব-১৬ দলের ক্যাম্পে সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও শুরুতে যেতে দিতে রাজি হননি তিনি। শেষ পর্যন্ত বাড়ির পাশের একজন রেফারি বুঝিয়ে বলার পর ক্যাম্পে যাওয়ার অনুমতি পায় জিকো।

আনিসুর রহমান জিকো পেশাদার ফুটবলে পা রাখেন মাত্র ষোল বছর বয়সেই। ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম লিগের দ্বিতীয় বিভাগের দল কল্লোল সংঘে যোগ দেন তিনি। সেই মৌসুমের শেষ ম্যাচে তিনটি ট্রাইব্রেকার থামিয়ে এবং পেনাল্টিতে নিজে গোল করে তাঁর দলকে প্রথম বিভাগে তুলেছিলেন জিকো।

চট্টগ্রাম লিগে নজরকাড়া পারফরম্যান্সের পর ২০১৫ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলা ফরাশগঞ্জ ক্লাব নিজেদের দলে নেয় আনিসুর রহমান জিকোকে। ফরাশগঞ্জের জার্সি গায়ে গোলকিপিংয়ে একেবারে অনবদ্য ছিলেন জিকো। তার এমন প্রতিভা নজর এড়ায়নি বিপিএলের ক্লাবগুলোর। তাই পরের বছরই মুক্তিযোদ্ধা সংসদে চুক্তি স্বাক্ষর করেন চট্টগ্রামের তরুন। এক মৌসুম পরই অবশ্য মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব ছেড়ে চুক্তিবদ্ধ হন সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবের সাথে।

সবশেষে ২০১৮ সালে যোগ দেন নবাগত ক্লাব বসুন্ধরা কিংসে। কিংসে তখন তিন নম্বর গোলকিপার হিসেবেই দলে ছিলেন জিকো। তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল তার। মৌসুমের শুরুতেই প্রথম গোলরক্ষক ইনজুরিতে পড়ায় কিংসের কোচ অস্কার ব্রুজন ভরসা রাখেন জিকো’র উপর। আর সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে কিংসের ২২ নম্বর জার্সিটাকে আলাদাভাবেই চিনিয়েছেন আনিসুর রহমান জিকো।

বসুন্ধরা কিংসের হয়ে এএফসি কাপে অভিষেক ম্যাচেই তিনটা পেনাল্টি ঠেকিয়ে ইতিমধ্যেই রেকর্ডবুকে জায়গা করে নিয়েছেন জিকো। তাঁর এমন পার্ফরম্যান্সে এএফসি’র ওয়েবসাইটে তাঁকে সম্বোধন করা হয়েছে ‘দ্য ওয়াল’ বলে! এছাড়া সব ম্যাচেই বসুন্ধরা’র জাল অক্ষত রাখতে সামর্থ্যের সবটুকু দিয়েই চেষ্টা করেন তিনি। বিশেষ করে পেনাল্টি শট ঠেকাতে জুড়ি নেই এই তরুণ গোলরক্ষকের।

২০২০ সালে নেপালের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে জাতীয় দলে অভিষেক হয় আনিসুর রহমানের। অভিষেকের পর থেকেই ধারাবাহিকভাবেই দলকে ভরসা জুগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। পুরোনো গল্প বাদ দিলেও, সম্প্রতি এএফসি এশিয়া কাপ পূর্ববর্তী ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে প্রীতি ম্যাচে জিকোর দুর্দান্ত নৈপুণ্যের সুবাদেই গোলশূন্য ড্র করতে পেরেছিল বাংলাদেশ। এছাড়া মূল বাছাইপর্বের উদ্বোধনী ম্যাচে শক্তিশালী বাহরাইন, বাংলাদেশের বিপক্ষে গোল পেয়েছে দুইটি। অথচ ‘জিকো’ অসাধারন সব সেভ না দিলে হয়তো ব্যবধানটা ৪/৫ গোলের হতে পারতো।

গোলকিপারদের সাধারনত একটু বেশি উচ্চতার হতে হয়। কিন্তু সে তুলনায় আনিসুরের উচ্চতা কিছুটা কম। তবে কম উচ্চতা নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই তার। গড়পড়তা উচ্চতা নিয়েই রীতিমতো গোলমুখে রাজ করে যাচ্ছেন জিকো। এটা ঠিক যে, উচ্চতা বেশি হলে হয়তো আরও ভালো করতে পারতেন জিকো।

কম উচ্চতার গোলকিপারদের উঁচু বল ধরতে সমস্যা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সব বাধা ডিঙিয়ে দ্রুতই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন আনিসুর। ছয় গজের ভেতরই বেশি ভালো করেন তিনি। তাছাড়া উচ্চতার এই ঘাটতি পুষিয়ে দিয়েছে আনিসুরের আত্মবিশ্বাস।

বাংলাদেশ সাধারনত বড় দলের বিপক্ষে ম্যাচ খেলে বেশি। আর তাই গোলরক্ষককে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে হয়। তাছাড়া খেলার মূল পরিকল্পনা থাকে ‘লো ব্লক’। আর তাই ক্রমাগত প্রতিপক্ষের ক্রস, শট, হেডের ঝড় বয়ে যায় জিকোর উপর। নিজের সবটুকু দিয়েই সে-সব প্রতিহত করেন তিনি, অবশ্য তার প্রতিভার প্রকাশের আদর্শ জায়গা বাংলাদেশ কিনা সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, আরেকটু ভাল কোন ফুটবল দলের সদস্য হলে হয়তো এমন পারফরম্যান্স দিয়ে নিয়মিত ক্লিনশিট রাখতে পারতেন জিকো।

জাতীয় দলে যে দুইতিনজনের জায়গা একেবারে নিশ্চিত থাকে, তাদের একজন এই আনিসুর। মাঠের ৯০ মিনিট ক্লাব কিংবা জাতীয় দলকে জেতাতে সবকিছু করতেই প্রস্তুত এই তরুণ।

খুব বেশি কিছু হয়তো না, কিন্তু সত্যি বলতে এশিয়ার যেকোনো সেরা লিগে খেলার সামর্থ্য আছে আনিসুর রহমান জিকো’র, সামর্থ্য আছে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা গোলরক্ষক হওয়ারও। সেদিন হয়ত বেশি দূরে নয় যখন বাংলাদেশের গোলপোস্টের নিচে দাঁড়ানো ‘জিকো’ নামক এই অতন্দ্র প্রহরী একদিন সেরাদের একজন হয়ে উঠবেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...