ব্যাট-বলের লড়াই ছাপিয়ে এখন ক্রিকেটের অন্দরমহলের গল্পের প্রতিও ভক্তদের তুমুল আগ্রহ। ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত জীবন কিংবা মাঠের বাইরে প্রিয় ক্রিকেটারদের নানা কান্ড জানতে চান দর্শকরাও। খেলার বাইরে ক্রিকেটারদের সবচেয়ে বড় আড্ডাখানা আসলে ড্রেসিং রুম। দলের নানা পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত আসে এই ড্রেসিং রুম থেকেই। এছাড়া ক্রিকেটাররা সবাই মিলে একটা লম্বা সময় কাটান এখানে।
ফলে ড্রেসিং রুমে ক্রিকেটাররা অদ্ভুত সব কাণ্ডও করেন। সেগুলোর কিছু হয়তো দর্শকদের সামনে আসে তবে বেশিরভাগই বাইরে থেকে জানা যায় না। যেন গোপন এক দুনিয়া। তবে, কোনো না কোনো সময় সেগুলো হয়তো জানা যায় ওই ক্রিকেটারদের মুখ থেকেই, বিশেষ করে অবসরের পর এই গল্প গুলো বলেন ক্রিকেটাররা। সেসব মুখরোচক গল্পগুলো নিয়েই এবারের আয়োজন।
- সৌরভ গাঙ্গুলিকে এপ্রিল ফুল
২০০৫ সালে তখন ভারতের অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। এপ্রিল ফুল ডেতে দলের অন্য ক্রিকেটাররা অধিনায়কের সাথে করেছিলেন প্র্যাঙ্ক। যুবরাজ সিং, বীরেন্দ্র শেবাগ ও হরভজন সিং মূলত এই কাণ্ডটি করেছিলেন। তাঁরা কতগুলো কাল্পনিক পত্রিকা নিজেরা তৈরি করেছিল। সেখানে সৌরভের সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। সেখানে সৌরভ দলের ক্রিকেটারদের ভীষণ সমালোচনা করেছেন।
ফলে টিম মিটিং ক্রিকেটাররা এর প্রতিবাদ জানায়। তাঁরা সৌরভের কাছে জানতে চায় অধিনায়ক হয়ে মিডিয়ার সামনে তিনি কী করে এভাবে দলের সমালোচনা করলেন। ওদিকে সৌরভ সবাইকে বুঝানোর চেষ্টা করছেন যে তিনি এমন কোন সাক্ষাতকার দেননি। এমনকি সৌরভকে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিতেও বলেছিল। শেষে সহ-অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড় বলে দেয় যে দলের সবাই সৌরভের সাথে প্র্যাঙ্ক করেছে। তখন মজা করে ব্যাট নিয়ে শেবাগ, যুবরাজদের তাড়া করেন সৌরভ।
- ড্রেসিং রুমে দাউদ ইব্রাহীম
সেই সময় ক্রিকেট মাঠে এখনকার মত এত কড়াকড়ি নিয়ম কানুন ছিল না। ১৯৮৭ সালে শারজাহতে এক ক্রিকেট টুর্নামেন্টের সময় ভারতের ড্রেসিং রুমে ঢুকে গিয়েছিলেন অন্ধকার দুনিয়ার বাদশাহ দাউদ ইব্রাহীম। তখন ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হচ্ছিল। সেই সময় ড্রেসিং রুমে গিয়ে দাউদ ইব্রাহীম ভারতের ক্রিকেটারদের ফিক্সিং এর অফার দেন।
দলের সবাইকে একটি করে টয়োটা গাড়ি দেবারও ঘোষণা দেন। পরে ভারতের ক্রিকেটাররা ক্ষীপ্ত হয়ে দাউদ ইব্রাহীমকে কলার ধরে ড্রেসিং রুম থেকে বের করে দিয়েছিল বলে শোনা যায়। এই ঘটনা অনেক পরে জানিয়েছিলেন কপিল দেব ও দীলিপ ভেঙসরকার।
- ড্রেসিং রুমে বুলিং ও বিভাজন
ইংল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার কেভিন পিটারসেন তাঁর বইয়ে ইংল্যান্ড ড্রেসিং রুমের অজানা এক ঘটনা তুলে ধরেছিলেন। তিনি জানা একসময় ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররা একে অপরকের বুলিং করতো। ফলে শুধু প্রতিপক্ষ নয় দলের মধ্যেও করতে হতো লড়াই।
বিশেষ করে যারা দক্ষিণ আফ্রিকার বংশদ্ভুত তাঁদের সাথে বিরূপ আচরণ করা হতো। এমনকি অনুশীলনের সময় পুরো দল ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যেত। ফলে দলের মধ্যে একটি বাজে আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল। অবশ্য তিনি এটাও জানান যে সেগুলো পরে ঠিক করা হয়েছিল। এরপর আর কখনো ইংল্যান্ড দলের মধ্যে এমন বিভাজন তৈরি হয়নি।
- জন রাইট ও বীরেন্দ্র শেবাগ দ্বন্দ্ব
২০০০ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। তখন ভারতীয় দলে মাত্র এসেছেন বীরেন্দ্র শেবাগ। অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি ও কোচ জন রাইট তখন চেষ্টা করে যাচ্ছেন তরুণ শেবাগকে বেশি সুযোগ দিতে। অনেক প্রতিভা থাকলে তখন শুধুই আক্রমণাত্মক ব্যাটিং টাই জানতেন শেবাগ। ফলে অনেক সময় বাজে বলেও নিজের উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে আসতেন। একবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটা ওয়ানডে ম্যাচেও এমন বাজে বলে আউট হয়ে এসেছেন শেবাগ।
তখন জন রাইট রেগে গিয়ে শেবাগের কলার ধরেছিলেন। জন রাইট শেবাগকে বলেছিলেন, ‘এভাবে তুমি কীভাবে নিজের উইকেট দিয়ে আসতে পারো? এরপর এমন ভাবে প্যাড খুলছো মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি!’ পরে দলের সিনিয়র ক্রিকেটাররা দুইজনকে সামলান।
- শোয়েব আখতার ও মোহম্মদ আসিফ দ্বন্দ্ব
২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসরের কথা। বিশ্বকাপের মধ্যেই শোয়েব আখতার নাকি মোহম্মদ আসিফকে ব্যাট দিয়ে আঘাত করেছিলেন। মূলত তাঁরা দুইজন ও পাকিস্তানের অলরাউন্ডার শহীদ আফ্রিদি নিজেদের মধ্যেই মজা করছিল।
তাঁর একজন আরেকজনকে নিয়েও মজা করছিল। এরমধ্যে একসময় আসিফের কোন একটা কথায় রেগে যান শোয়েব আখতার। তাঁর আসিফকে ব্যাট দিয়ে আঘাত করেন শোয়েব।
- বিরাট কোহলিকে বোকা বানানো
এই মুহুর্তে ক্রিকেট বিশ্বের রান মেশিন বিরাট কোহলি। তবে এই ব্যাটসম্যান ছোটবেলা থেকেই শচীন টেন্ডুলকার অনুসরণ করেছেন। এমনকি নিজের অভিষেক সিরিজেও শচীনের সাথে ড্রেসিং রুমে কথা বলার জন্য ছটফট করছিলেন বিরাট। তখনই যুবরাজ অভিষিক্ত বিরাটের সাথে প্র্যাঙ্ক করার সিদ্ধান্ত নেন।
যুবরাজ ও আরো কয়েকজন মিলে বিরাটকে বোঝান যে অভিষেকের আগের শচীন টেন্ডুলকারের পাঁ ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিতে হয়। ভারত দলের সবাই এটা করেছে। ফলে বিরাটও শচীনকে দেখে তাঁর পাঁ ছুয়েছিলেন। ওদিকে যুবরাজরা সেই সময় হাসিতে ফেটে পড়েন। পরে শচীন বিরাটকে বুঝিয়েছিলেন যে এখানে এমন কোন নিয়ম নেই।
- ভিভ রিচার্ডস আতঙ্ক
পাকিস্তানের পেসার ওয়াসিম আকরাম তখন সবেমাত্র আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পন করেছেন। ওদিকে ভিভ রিচার্ডস তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মহাতারকা। পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের এক টেস্ট ম্যাচে তখন দারুণ বল করছেন ওয়াসিম আকরাম। ভিভ রিচার্ডসকে বাউন্সার মেরে তাঁর ক্যাপ ফেলে দিয়েছিলেন। এরপর আবার ভিভকে স্লেজিং করেও কিছু বলেছিলেন ওয়াসিম আকরাম।
পরে ভিভ রিচার্ডস তাঁকে স্লেজিং করতে মানা করেন এবং বলেন যে এরপর বাউন্সার করলে সোজা বাউন্ডারি মারবেন। তরুণ ওয়াসিম আকরাম ভয় পেয়ে পাকিস্তানের অধিনায়ক ইমরান খানকে বলেন এই কথা। ইমরান খান সাহস দিয়ে বলেন কিছু হবেনা, বাউন্সার করে যাও। ওয়াসিম আকরাম আবার বাউন্সার করলে আবারো পরাস্ত হন ভিভ। তখনো ভিভকে স্লেজিং করেন ওয়াসিম আকরাম।
এরপরের বলে অবশ্য ভিভকে বোল্ড করেছিলেন ওয়াসিম আকরাম। পরে দিনের খেলা শেষে পাকিস্তানের ড্রেসিং রুমের সামনে এসে ওয়াসিম আকরামকে খুঁজছিলেন ভিভ। তখন অবশ্য ভিভের কাছে ক্ষমা চেয়ে কোন রকমে পাড় পেয়েছিলেন ওয়াসিম আকরাম।
- মদ্যপ অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস
২০০৫ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম যখন অস্ট্রেলিয়া হারলো সেই ম্যাচের আগের রাতের ঘটনা। ম্যাচের আগেরদিন অজি ক্রিকেটার শেন ওয়াটসনের জন্মদিন ছিল। ফলে দলের সবাই জন্মদিন পালন করতে গিয়েছিলেন একসাথে। তবে সবাই রাতে হোটেলে ফিরলেও অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস ফেরেন ভোর বেলা।
প্রথমে কোচ বুঝতে পারেন যে সাইমন্ডস মদ্যপ অবস্থায় আছেন। শেষ পর্যন্ত টসের একদম আগ মুহুর্তে তাঁকে দল থেকে বাদ দেন অধিনায়ক রিকি পন্টিং।
- ছোট্ট পার্থিব প্যাটেল
কিংবদন্তি স্টিভ ওয়াহ সেবার তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ম্যাচটা খেলতে নেমেছেন। ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার সেই ম্যাচ তখন ড্র এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ওদিকে ব্যাটিং করে চলেছেন স্টিভ ওয়াহ। সেইসময় ওয়াহকে বিরক্ত করতেই পার্থিব বলেছিলেন, ‘শেষবারের মত তোমার পছন্দের স্লগ সুইপ খেলে নেও।’
তখন ওয়াহ খানিকটা ধমকের সুরেই বলেছিলেন, ‘সম্মান দিয়ে কথা বলো। আমি যখন টেস্ট খেলা শুরু করি তুমি তখন ন্যাপকিন পরে ঘুরতে।‘ এরপর আর ওয়াহকে কিছু বলার সাহস করেননি পার্থিব প্যাটেল। পরে এই কাজের জন্য ড্রেসিং রুমে গিয়ে ভারতের সিনিয়র ক্রিকেটারদেরও বকুনি খেতে হয়েছিল পার্থিব প্যাটেলকে।