ফুটবল খেলাটার সমস্ত রোশনাই ছিল তাঁকে ঘিরে!
সময় তখন ২০০২ বিশ্বকাপ। ঝলমলে গ্ল্যামারাস এই মহাসম্মেলন এশিয়ায়। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই মহানায়ক একজনই! প্রিন্স অফ ম্যানচেস্টার! ইতোমধ্যে নাইটহুডের দাবি তোলা হয়েছে খেলার মাঠেই!
এই ম্যাচটাও আমার লাইভ দেখা! বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ার ম্যাচ। ২-১ গোলে পিছিয়ে ইংল্যান্ড! গ্রীসের সাথে অন্তত ড্র দরকার অন্য ম্যাচের সমীকরণ মাথায় রেখে।
‘আই ডোন্ড বিলিভ ইট! ডেভিড বেকহ্যাম, স্কোর্স দ্য গোল
টু টেইক ইংল্যান্ড অল দ্য ওয়ে টু দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালস!
গিভ দ্যাট ম্যান আ নাইটহুড’
কিন্তু দিনটা মনে আছে, তখন থেকেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ভক্ত আমি, এসব কারণে মাঝেমধ্যে ইংল্যান্ডের খেলা দেখতাম! আবার ইংল্যান্ডের খেলা আলাদা করে দেখতাম বললে ভুল হবে, টেলিভিশনে চলতোই দুইটা জিনিস, এক আকাশের নিচে – একুশে বাংলায় আর খেলার চ্যানেল।
কিন্তু সেই গুজবাম্প! ফ্রি কিকে কেউ গোল করার যে আনন্দ সেটা ভুলিনাই। দশ বছর! এমনকি প্রায় বিশ বছর পরেও সেই অনুভবটা অবশ্যই মনে আছে!
একটা মানুষ একটা গোল করে পুরো স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে দিল, টেলিভিশন ক্যামেরা থরথর করে কাঁপছে, কোনো শটই স্থির না, কোনো দৃশ্যই মনোটোনাস না!
ইংল্যান্ডের ফুটবল ইতিহাসেরই এই অন্যতম স্মরণীয় ম্যাচটি হয়েছে থিয়েটার অফ ড্রিমসে, ওল্ড ট্র্যাফোর্ড! ইংল্যান্ডের হয়ে গোল করেন ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের ট্রেবলজয়ী দুই নায়ক, টেডি শেরিংহাম ও ডেভিড বেকহ্যাম!
বেকহ্যাম, খুব সম্ভবত সেদিনই ইংল্যান্ডের মানুষের ভালোবাসা প্রথম পান! এছাড়া তো উপায় নেই! ইংলিশরা বেকহ্যামকে কখনোই আপন করে নিতে পারেনি! ডেভিড বেকহ্যামের চেয়ে অনেক কম দিয়েও অনেক ইংলিশম্যান নাইটহুড পেয়েছেন! তাদের নাম না বলি (টমি শেলবিকেও উদাহরণ ধরতে পারেন)।
ডেভিড বেকহ্যাম ৯৮-তেই লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন আর্জেন্টিনার সাথে! সিমিওনের ট্যাকলে পড়ে যান বেকহ্যাম! বেকহ্যাম মেজাজ সামলাতে না পেড়ে সিমিওনের দিকে ব্যর্থ হাওয়াই লাথি মারেন, সেটা লেগেছে কী লাগেনি বোঝা মুশকিল! কিন্তু রেফারির সিদ্ধান্তে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন তরুণ সুপারস্টার! (খেলা দেখা হয়নি)
‘Beckham’s world began to crumble around him.’ – এভাবেই লেখা হয়েছে তখনকার পত্রিকায়!
দ্য মিররের হেডলাইন ছিল এমন! ‘10 heroic lions, one stupid boy’ ইংল্যান্ডের নায়ক হতে না পারলেও বেকহ্যাম ততদিনে ফার্গুসনের আদরের ছেলে, ৯৯-তে বুঝিয়ে দিয়েছেন কেন তিনি এতো আদরের!
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ইতিহাসের সবচেয়ে ঐতিহাসিক দুটো গোলের দুটিই আসে বেকহ্যামের কর্নার কিক থেকে! (১৯৯৯ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফাইনাল)
বেকহ্যাম নিজেই বলেন, ‘আমাকে প্রথম ফোন দেন ফার্গুসন, বলেন, বেটা ম্যানচেস্টার ফেরো। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
ফার্গুসনের আদরও বেশিদিন টেকেনি, আর বেকহ্যামের ব্রিটিশ জনতার মন জয় করাও এতো সহজ ছিল না। পরের প্রিমিয়ার লিগ মৌসুমে ম্যান ইউনাইটেডের বাসে ইট ছোড়ে অতি দেশপ্রেমী ওয়েস্ট হ্যাম সমর্থকরা, চ্যান্ট ছিল বাহিরে, ‘আমরা বেকহ্যামকে ঘৃণা করি।’ (ম্যান ইউনাইটেড.কম)
তবে বেকহ্যাম এগিয়ে গেছেন! তিনি ততদিনে বুঝে নিয়েছেন ফুটবলার হিসেবে তিনি যত বড় তার চেয়ে বড় পোস্টারে, মানুষের ফ্যান্টাসি জগতের নায়ক ডেভিড বেকহ্যাম আজও আছেন সেখানেই। নারীরা তো বটেই, পুরুষরাও তাকে দেখে বলেন, ‘এমন যদি হতো!’
নিজের ইংল্যান্ডের জার্সির দুন্নাম ঘোচাতে পেরেছেন কিছুটা ডেভিড বেকহ্যাম! সেই ১৯৯৮-এর ভিলেন ২০০২ সালে নায়ক! ইংল্যান্ডের মানুষের অপছন্দের বেকহ্যাম ততদিনে অধিনায়ক।
ছবিতে দেয়া ডেভিডকে দেখেই প্রেমে পড়েছিলাম! জাপান, কোরিয়ায় তৎকালীন বিশ্বকাপে প্রচুর মানুষ এই হেয়ারকাট দেয়! বেকহ্যাম মো-হক এখনো বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে আলোচিত চুলের কাটের একটি!
পেনাল্টিতে গোল দিয়ে আর্জেন্টিনাকেই গ্রুপ পর্বেই বিদায় করে দেন লাল জামা পরিহিত ইংল্যান্ড অধিনায়ক। সেবার বেকহামেরই বিশ্বকাপ হওয়ার কথা। যদি না ব্রাজিল তেমন অতিপ্রাকৃত দল নিয়ে রোনালদিনহোর অলৌকিক গোল দিয়ে সিম্যানকে এমন অবিবেচক বানিয়ে ফেলতো।
বেকহাম যে ইংল্যান্ডের হয়ে কিছু জিতবেন না! সে মনে হয় কোন পঞ্জিকাতেই লেখা ছিল।ইংল্যান্ডে থাকবেন না, সেটাও বোধহয় লেখাই ছিল! বেকহ্যামের পার্টনার ভিক্টোরিয়া, তার যাপিত জীবন, শোবিজ লাইফ, আলো ঝলমলে কনফেত্তি ওড়া পথ ফার্গুসনের মনে ধরেনি।
নতুবা জীবনযাপন সংক্রান্ত অভিযোগে স্যার অ্যালেক্সের সাথে বনিবনা করে নিতেই পারতেন। না সে কীভাবে হয়, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বলা চলে গরীবের সংসার তখন, নিজের ক্ষেতেই ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা পরিবারে পোষায় না বিশ্ব ফুটবলের মহাতারকা ডেভিড বেকহ্যামের। তাও ওপর বাবাপ্রতীম চরিত্রের সাথে মনোমালিন্য! ড্রেসিং রুম স্ক্যান্ডাল থেকে শুরু করে মাঠেই বাদানুবাদ।
তিনি চলে গেলেন, গ্যালাকটিকোর অংশ হয়ে! রাজত্ব দিয়ে গেলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর হাতে, তিনিও একই কাজ করেছেন। বেকহ্যাম রেয়াল মাদ্রিদে খেলেছেন, খেলেছেন এসি মিলানে! কিন্তু ম্যানচেস্টারে যা করে এসেছেন সেটা আর ফেরেনি তার বুটে!
ফুটবল ফ্যাশনিস্তাদের সবচেয়ে বড় আইডল, বিশ্ব ফ্যাশনের রাজধানী প্যারিসেও খেলেন। সেখানে ১০ ম্যাচ খেলে কান্নাঝড়া বিদায় নেন ফুটবল মাঠ থেকে! এর মাঝে ঘটে যায় কত নাটক! ২০১০ বিশ্বকাপে মেন্টর হিসেবেও যান ইংল্যান্ড দলের সাথে!
তবে সবচেয়ে বড় আলোড়নটা ফেলেন আমেরিকায়! ডেভিড বেকহ্যামের আমেরিকা যাত্রা ছিল ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম বড় ঘটনার একটি! লস অ্যাঞ্জেলস এমনিতেই রোশনাইয়ের শহর, সেখানেই স্ব আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেন ফুটবল সুপারস্টার!
বেকহ্যাম কখনো গ্রেটার দ্যান ফুটবল ক্যারেক্টার হয়ে ওঠেননি ঠিক। কিন্তু বেকহ্যাম সেই ফুটবল পারসোনালিটি যাকে ঘিরেই আলাদা জগৎ তৈরি হয়ে যায় অনায়াসে।
বেকহ্যাম ফুটবলার হিসেবে অনেকের আদর্শ, মডেল হিসেবে অনেকের আদর্শ, ফুটবল তারকা হিসেবে অনেকের আদর্শ, ব্যবসায়ী হিসেবে অনেকের আদর্শ – সবশেষ কিন্তু অগ্রাহ্য করা মুশকিল একজন বাবা হিসেবেও বেকহ্যাম আদর্শ।
আধুনিক বাবার সংজ্ঞা বদলে দেয়া ডেভিড বেকহ্যামকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনিসেফ! টাকা থাকলেই হয় বলবেন না, জানেনই তো টাকা থাকলেই মানুষ মানুষ হয় না।