বছরের শুরুতেই নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট জয়। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম বড় সাফল্য। এরপর ঘরের মাঠে হারতে থাকা ম্যাচের চিত্রনাট্য নতুন করে লিখলেন আফিফ-মিরাজ। তবে এবার দুর্ভেদ্য কন্ডিশনে, কঠিনতম প্রতিপক্ষ। তবুও তাসকিন, শরিফুল, রাব্বিদের দিনে বাংলাদেশ দলকে নতুন করে চিনলো ক্রিকেট দুনিয়া। বোঝা গেল, বাঘ যেখানেই যাক বাঘ-ই থাকে।
বাংলাদেশের ছেলেরা কাল আসলে বাঘের মতই খেলেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এই ম্যাচ শেষ হতে হতে মাঝ রাত হয়েছে। অনেকেই হয়তো টিভি পর্দার সামনে বসেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকাকে তাঁদের মাটিতে প্রথমবারের মত হারানোর মুহূর্তটা নিজের চোখে দেখবেন বলে। বাংলাদেশ সেই স্বপ্ন পূরণ করেছে। অধিনায়ক তামিম দেশ ছাড়ার আগে বলে গিয়েছিলেন এবার আর শুধু লড়াই না, তাঁরা জিততে চান। তামিম কথা রেখেছেন, তাঁর অধিনায়কত্ব মনে ধরেছে।
উপমহাদেশের দল গুলোর জন্য সিনা দেশগুলো কঠিন পরীক্ষা ক্ষেত্র। তবুও বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মাটিতে বেশ কিছু স্মরণীয় জয় পেয়েছে। তবে নিউজিল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে অর্জের খাতা একেবারে শূন্যই বলা চলে। ফলে এইধরনের কন্ডিশনে বাংলাদেশ আদৌ কেমন দল তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল।
নিউজিল্যান্ডের ঘরের মাঠে টেস্ট চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে বাংলাদেশ জবাব দিয়েছিল। এবার বাকি ছিল শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা। দক্ষিণ আফ্রিকাকে আসলে কোন দেশের সাথেই তুলনা করা যায় না। এটি আসলে ক্রিকেটের ভিন্ন এক দুর্গ। কিছুদিন আগেই ভারতের মত দল এই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হোয়াইট ওয়াশ হয়ে এসেছে।
ফলে বাংলাদেশের জন্য এই দুর্গ ভেদ করা ছিল কঠিনতম কাজ। আর সেই কাজটাই করে দেখালেন সাকিবরা। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে প্রথম জয়। এর আগে অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশ আরেকটি জয় পেয়েছিল। সেটি ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। তবে রাবাদা-ডুসেনদের বিপক্ষে এই জয় ছাড়িয়ে গিয়েছে সবকিছুকেই।
তবে বাংলাদেশের সামনে এখনো দুটি দুর্গ ভেদ করা বাকি আছে। একটি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, আরেকটি পাকিস্তান। আপনি হয়তো খানিকটা অবাক হতে পারেন। কেননা এই দুই দলেই বিপক্ষেই বেশ কিছু জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে এবং পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে কোন জয় পায়নি বাংলাদেশ। এখন শুধু এই দুইটি জয় পেলেই বিদেশের মাটিতে ষোলকলা পূর্ণ হয়।
বিদেশের মাটিতে সাকিব-তামিমদের এমন সাফল্য বাংলাদেশকে ক্রিকেট বিশ্বের নজরে নিয়ে আসছে। বাংলাদেশ ওয়ানডে ফরম্যাটে ভালো ক্রিকেট খেলছে কয়েকবছর ধরেই। তবে বিদেশের মাটিতে সাফল্য ছিল খুব কম। এরমধ্যে ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলাটাই অন্যতম সাফল্য। তবে বিদেশের মাটিতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকার মত দলগুলোকে হারানোর মত ক্রিকেট খেলেনি বাংলাদেশ।
তবে এবার এই জয়গুলোও আসতে শুরু করেছে। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে কঠিন দুই কন্ডিশনে অবিশ্বাস্য দুই জয়। তাও আবার দুটি আলাদা ফরম্যাটে। ফলে দেশের বাইরেও যে বাংলাদেশ শক্তিশালি দল হয়ে উঠছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
আর দেশের বাইরে এই সাফল্য গুলো পাওয়ার অন্যতম কারণ তরুণ ক্রিকেটারদের সাহসী মানসিকতা। বিশেষ করে ওয়ানডে ফরম্যাটে অভিজ্ঞদের সাথে তরুণদের দারুণ একটা মিশ্রণ হয়েছে। সাকিব-তামিমরা নিজেদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে খুলে বসছেন। আবার শরিফুল-তাসকিনরাও তাঁদের আগুনঝড়া চোখ দিয়ে ঝলসে দিচ্ছেন প্রতিপক্ষকে।
বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের এই সাফল্য গুলোর মূল কারণ হচ্ছে সাহস। কখনো রাব্বি, শরিফুল কখনো জয়, এবাদতরা প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়াই করছেন। কঠিন কন্ডিশনেও জেতার জন্যই মাঠে নামছেন। রাব্বিদের একটা ইনিংস কিংবা শরিফুলদের একটা স্পেলই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
তবে সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে আসলে বাংলাদেশের পেসাররা। গত দুই বছরে বাংলাদেশ একটা সমৃদ্ধ পেস অ্যাটাক গড়ে তুলতে পেরেছে। তারমধ্যে তাসকিনের নতুন করে ফিরে আসা অন্যতম বড় প্রাপ্তি। শরিফুলের মত তরুণ তুর্কি উঠে এসেছেন। এছাড়া কখনো মুস্তাফিজ, কখনো এবাদতরাই আসলে জয়গুলো এনে দিচ্ছেন। মোদ্দাকথা বাংলাদেশের পেসাররা এই পেস বোলিং কন্ডিশনের সঠিক ব্যবহার করতে পারছেন।
ম্যাচের একটা প্রসঙ্গ না টানলেই নয়। ইনিংসের গোড়ায় তামিম-লিটন ভাল সূচনা এনে দিয়েছেন। সেটাকে টেনে নিয়ে গেছেন সাকিব আর ইয়াসির রাব্বি। শেষে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আর মেহেদী হাসান মিরাজরা ক্যামিও খেলেছেন। বোলিংয়ে তাসকিন-শরিফুলরা ঝড় তুলেছেন পেসে।
সাকিব উইকেট না পেলেও, লাগামটা টেনেই রেখেছিলেন। শুরুতে মিরাজ খরুচে বোলিং করলেও পরে চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফিরে এসেছেন, চার উইকেট নিয়ে ম্যাচ থেকে ছিটকে দিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকাকে। হাফ সেঞ্চুরিয়ান রাব্বি দারুণ এক ক্যাচ ধরেছেন ভ্যান ডার ডুসেনের। এই সবগুলো ভূমিকা এক হয়েই এসেছে জয়। আর ভূমিকাগুলো এতটাই প্রবল ছিল যে, ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচনটাও সহজ ছিল না।