সব আমাদের জন্য

১.

কল্পনার দুনিয়ায় বেঁচে থাকার আনন্দটাই আলাদা। অনেক বেশি নিরাপত্তাহীন আনন্দ। বাস্তবের রূঢ় সত্যকে অবাধে ছুঁড়ে ফেলার একপ্রস্থ স্বাধীনতা রয়েছে। কাজেই চট করে কেউ এই নিজের স্বপ্নে বানানো দুনিয়া থেকে বেরোতে চায় না। যারা মধ্যবিত্তের মাঠ থেকে লড়ে উঠে এসে বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিস যায়, যারা শিয়ালদা স্টেশনে ঝুড়ি মাথায় ফলবিক্রেতা, তারা সূর্যাস্তের পর একটা নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে।

একটা বড় চাঁদোয়ার আড়ালে তারা সবাই ঠাকুমার সোয়েটার বোনার মতো স্বপ্ন বুনে যায়। এর অনেকাংশে জুড়ে থাকে তাদের ছেলেবেলার হিরোরা। পলেস্তরা খসে পড়া দেওয়াল থেকে এখনও যারা উঁকি দিয়ে যায়। নোনা দেওয়ালের ঘরে সসম্ভ্রমে বিরাজমান হয়ে যারা অবিরত স্বপ্ন দেখাচ্ছে গোটা দুনিয়ার সব স্বপ্নপাগলদের। ফুটবল সেই স্বপ্নের একটা নাম।

বৃষ্টির কাদা, প্রচণ্ড রোদ বা মেঘলা করে আসা প্রেমময় বিকেলজুড়ে যে স্বপ্ন দেখিয়ে চলে গ্রামগঞ্জ থেকে শহরতলির সমস্ত কচিকাঁচার দলকে। কেউ কেউ বড় হয়ে যায় পরে। মাথার উপর থেকে ছাদ সরে গেলে স্বপ্নের সোয়াটার একপাশে পড়ে থাকে অবহেলায়। উলের সুতোয় জট পড়ে। কাঠফাটা রোদের তীব্রতায় তাদের দেহে নেমে আসে ঘাম। তবু শেষ রাতের মিঠে হাওয়ায় ছবিগুলো স্বপ্ন হয়ে নেমে আসে। ফুটবল যে এক স্বপ্নের নাম।

২.

২০০৪ ইউরো।

নিজের দেশে আয়োজিত ইউরো কাপে প্রথমবার বড় টুর্নামেন্টে দেশের মেরুন জার্সিতে গায়ে সোনালী কার্লি চুলে বছর উনিশের এক তরুণ। গ্রিসের বিরুদ্ধে এল দেশের হয়ে প্রথম গোল। তখনও পর্তুগাল টিমকে খাতায় কলমে অতটা হেয় করার মতো ছিল না। তারকা অধিনায়ক লুইস ফিগো, জন্মসূত্রে ব্রাজিলিয়ান হয়েও পরে পর্তুগালের নাগরিকত্ব নিয়ে খেলা ডেকো, রুই কোস্তা, হেল্ডার পস্টিগা, নুনো গোমেজ, রিকার্ডো কার্ভালহো-সহ টিমটা বেশ মজবুত।

খেলছেও ভাল। গ্রুপ পর্ব থেকে সোজা নিজের দেশের মাঠে ইউরো কাপের ফাইনালে পৌঁছে গেল দল। সে তরুণটির পারফরমেন্সও চোখে পড়ার মতো। বেশ বোঝা গেছিল, এক তারকার উত্থান ঘটে গেছে এই ইউরোতে। বেশ কয়েকটা গোলের ধরণটাই বুঝিয়েছে এ ছেলে তিনকাঠিটা ভালই চেনে। হেডে, লং শটে গোলগুলো সেটাই প্রামাণ্য হিসেবে রয়ে গেছে।

এ হেন নবউত্থিত তরুণটি যখন নিজের প্রথম বড় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেই কাপ জেতার স্বপ্নে বিভোর, তখনই কার্যত গোটা বিশ্বকে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে রেখে কাপে চুম্বন করল আনকোরা গ্রিস! ছেলেটি হতাশ হল, ভেঙে পড়ল না। সেই বছর উনিশের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ভেঙে পড়েনি কখনও।

তার পরের বছর রোজারিও থেকে উঠে আসা এবং গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সিতে ভোগা রুগ্ন এক লম্বা চুলের ছেলে, যাকে বার্সোলোনা প্রথম সই করিয়েছিল একটা ন্যাপকিন পেপারে, সে প্রথম দেশের জার্সি গায়ে চাপাবে। জোসে পেকারম্যানের তত্ত্বাবধানে থাকা টিমে ঢুকে পড়ে সে মাতিয়ে রাখবে সারা দুনিয়াকে।

গ্যাব্রিয়েল হেইঞ্জ, জুয়ান রোমান রিকেলমে, হার্নান ক্রেসপোদের তারকাখচিত নীল-সাদা টিমের খেলায় যে আলাদা করে নজর কেড়ে নেবে। তখনও বিশ্ব জানেনি লিওনল মেসি কে। কী তার পরিচয়, কী তার প্রতিভা। মারাদোনা উত্তর আর্জেন্টিনার বহমানতার ধারক ও বাহক হয়ে একনিষ্ঠ আধিপত্য কায়েমে যে অনেকটাই সফল হবে। ২০০৬ বিশ্বকাপে জার্মানির মাঠ যাকে শূন্য হাতে ফেরাবে। ২০১৪র রিও ডি জেনিরো যাকে কাঁদাবে।

যার সাথে অশ্রুর বরষা ঝরবে অগণিত ফুটবলভক্তের নয়নে। আর্জেন্টিনার এই ফুটবল জেতার জন্য নয়, জেতাহারার প্যারাডাইম পেরিয়ে গোটা বিশ্ব যাকে তকমা দিয়ে দেবে ফুটবল ঈশ্বরের। পূর্বসূরী দিয়েগোর একচ্ছত্র সাম্রাজ্যে যে পরবর্তীতে ভাগ বসাবে।

৩.

পর্তুগালের রাস্তায় একসময় ঝাঁট দেওয়ার কাজ করা সামান্য দাঁত উঁচু ক্রিশ্চিয়ানো ছেলেবেলায় বড়দের দলে জায়গা পেত না। বলবয় হয়ে খেলা দেখে যেত চুপ করে। টুঁ শব্দটি করারও জো নেই, পরেরদিন যদি মাঠে ঢুকতেই না দেয়! জেদী মনোভাবের হয়তো সেখানেই শুরু। যার ছাপ পরতে পরতে পড়েছে গোলের পরে সেলিব্রেশনের ভঙ্গিমায়। দু’হাত ওপর থেকে নিচে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে রয়েছে অসংখ্য প্রতিকূলতাকে এক নিমেষে ছিটকে দেওয়ার লড়াই।

ছেলেবেলায় অর্থহীন, কপর্দকহীন ক্রিশ্চিয়ানো সূদূর মাদেইরায় নিজের পরিবারকে পিছে ফেলে লিসবনে চলে এসেছিল ফুটবলের টানে। তার যে প্রতিভা, তার যে লড়াইয়ের অসম্ভব ক্ষমতা – তা গোটা বিশ্বকে দেখানোর কারণে। আজ ইউরোপের বিভিন্ন বড় ক্লাব তার জন্য যে দর রাখে, সেই পাহাড়ের চূড়োয় পৌঁছতে ক্রিশ্চিয়ানোর সময় লেগেছে পাক্কা বারোটি বচ্ছর! লড়াই, শুধু লড়াই – কোনও আপোষকে সঙ্গী করে ক্রিশ্চিয়ানো স্পোর্টিং লিসবনেও খেলেনি, কদাপি ওল্ড ট্র্যাফোর্ড, স্যান্টিয়াগো বার্নাব্যু বা অধুনা জুভেন্টাসেও নয়।

আর অন্যদিকে জন্মদত্ত প্রতিভা নিয়ে জন্মানো লিওনেল ক্যারিয়ারের শুরুতেই আরেক ক্ষণজন্মাকে পাশে পেয়েছেন, যিনিও কিছুটা ক্রিশ্চিয়ানোর মতো পরিবার থেকেই উঠে আসা এক তুর্কি। রোনালদিনহো, জাভি-ইনিয়েস্তার ছায়ায় বেড়ে ওঠা লিওনেল কাতালুনিয়ার এক বটবৃক্ষ।

এখানে লড়াই আছে প্রমাণের, বিশ্বের দরবারে রোনাল্ডোর আগুনে জেদের পাশে লিওনেল যেন শান্ত, স্নিগ্ধ গতিতে বয়ে যাওয়া বেসোস নদী, আপন খেয়ালের বশে লম্বা চুলের বেঁটেখাটো চেহারার লিওনেল ড্রিবল করে, হোল্ড করে শরীরের একটা ছোট্ট টার্নে ডিফেন্ডারদের কাটিয়ে বেরিয়ে যায়, আমরা বোকারা কলকাতার ট্র্যাফিক জ্যামের গরমের মাঝে ঘাম মুছে বলে ফেলি, ‘আহা!’ লিওনেল বাঁ পায়ে ছেলেবেলার রোগ সারিয়ে বড়বেলার ব্যালন ডি অরের কাছে ছুটে যায়, বার্সেলোনার সুন্দরীরা তার মাঝে বসত করা প্রেমের কবিতার সন্ধান পায়। লিওনেল যতবার বল নিয়ে বাঁপায়ে ইনস্টেপ-আউটস্টেপের ছোট্ট টাচে পাস খেলে, ড্রিবল করে, ততবার স্পেনের একটা ঘুপচি ঘরে বসে লোরকা কবিতা লেখেন।

বুনুয়েল-দালি পাবে বসে আরেকটা কনিঁয়াগ অর্ডার করেন। এ শিল্পকে নিঝুম সন্ধ্যায় উপভোগ করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া লিওনেল গোল করে, আমরা সারাদিনের কর্মযজ্ঞের পর বাড়ি ফিরে আরামের নি:শ্বাস ফেলি।

চলার পথে পায়ে পায়ে লেগে থাকা এই ফুটবলের আগামী প্রজন্ম নতজানু হয়ে থাকবে এ দু’জনের চরণে। পঁচানব্বই পরবর্তীতে জন্মানো গোটা প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সাথে এই দুই আইকন বেড়ে উঠেছে সমান ছন্দে। কখনও পড়ে গেছে, কখনও হতাশ হয়ে আর্মব্যান্ড মাটিতে ফেলে দিয়েছে ছুঁড়ে, আবার কখনও অফ দ্য বল দৌড়ে সেকেন্ডের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছে গোলের কাছে। কখনও বাঁ পায়ের ইনসুইংয়ে ফ্রিকিকটা জড়িয়ে দিচ্ছে জালে।

একটা গোটা প্রজন্ম শুধু মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল আর উত্তম-সৌমিত্রের মতো লড়াই করে গেল মেসি-রোনাল্ডোকে নিয়ে। ঝগড়া, তর্কের মাঝে গোলসংখ্যা বাড়িয়ে চলেন দু’জনেই। দু’জনেই দুই আলাদা গোলার্ধের দেশের অধিনায়ক। দেশের রিপ্রেসেন্টেটার। তাদের জন্য কার্যত বিশ্ব দুই ভাগ হয়ে গেল শুধু একটা প্রজন্মের কাছে। কত কারোর স্কুল কামাই হয়েছে, কত কারোর প্রেমিকা পথে অপেক্ষা করে চলে গেছে, কত কেউ নিরাশা থেকে আশার একবিন্দু আলো দেখতে পেয়েছে শুধু এই দুই ফুটবলখেলিয়ের জন্য।

রাতের পর রাত জেগে কত শত তরুণ তার ঘরের দেওয়ালে লাগিয়ে রেখেছে পোস্টার। সে পোস্টারে আজ ঘুণ ধরছে, দু’জনের বয়স বাড়ছে প্রকৃতির নিয়মে। আজ সে প্রজন্মটা বড় হয়েছে, তারা বৃদ্ধ হচ্ছে। ফুটবল মাঠে হয়তো আর বছর দেড়েক, একজনের ছত্রিশ এবং অপরজনের চৌঁত্রিশ। দ্বন্দ্ব কি সত্যিই ছিল? সত্যিই ছিল রেষারেষির পাল্লা ভারী? কে জানে, মহাকালের কাছে বিচারাধীন।

আমরা নিরঙ্কুশ, আমরা রাত জেগে শিক্ষা নিই, অকল্পনীয় জেদ এবং অনুপম শিল্পকীর্তি দেখি। লড়ে যাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। আর আবেগে ভাসি। বিশ্লেষণের চেয়েও আবেগ অনেক বেশি জীবন্মুখ। আমাদের গড়পড়তা জীবনে বাঁচিয়ে রাখে তো আবেগ, তাই না? মেসি-রোনালদো কি সেটা জানে? হয়তো। না হলে, একজন পড়ে গেলে অপরজন হাত ধরে তুলতে আসে কেন। সুমন বলেছিলেন না, ‘সব আমাদের জন্য, সব আমাদেরই জন্য!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link