চট্টগ্রামের খান: খেলাধুলার ঐতিহ্যবাহী বাতিঘর

খান পরিবার – চট্টগামে এই দুই শব্দ কাউকে বললে একনামে পরের বিশেষণটুকু আপনাকে বলে দেবে – ‘খেলার বাতিঘর’। হ্যা, ভুল শুনছেন না। অনেক আগে থেকেই এদেশের ক্রীড়াঙ্গনের আলোক মশালটা এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্বটা অনেকাংশে নিজেদের হাতেই তুলে নিয়েছে চট্টলার এই খান পরিবারটি।

খান পরিবারের খেলার ঘরে বাতিঘর জ্বালানোর কথা উঠলে সর্বপ্রথম আসবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খানের প্রসঙ্গ । ১৯৯৭ এর আইসিসি ট্রফি জিতে তো বাংলাদেশ ক্রিকেটকে বিশ্ব ক্রিকেটের অভিজাত পরিবারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল একরকম তাঁর ওই দলটাই। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে তো, এটাই এখন অবধি ক্রিকেটে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা সাফল্য।

আকরাম খান ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন একসময়, তবে বিদায় জানায়নি অভিজাত খান পরিবারটি। আলোক মশাল আকরাম খানের হাত থেকে নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিলেন আকরাম খানেরই ভাতিজা নাফিস ইকবাল ও তামিম ইকবাল। নাফিস ইকবালের ক্রিকেট ক্যারিয়ার নানা কারণে সীমিত হয়েছে, তবে সে অভাব পুষিয়ে দিতে তামিম ইকবাল খেলে চলেছেন এখনও – এমনই স্বমহিমায় যে মনে করা হয় বাংলাদেশ ক্রিকেটের এখন পর্যন্ত সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান তিনিই। সদ্যই ইতি টেনেছেন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের, ১৬ বছরের লম্বা এক যাত্রা শেষে।

যাই হোক, খেলার জগতে খানদের এই আগমনের মূল হোতা কিন্তু আরেকজন – ইকবাল খান! তামিম ইকবালের সবচাইতে প্রিয় এই মানুষটিই সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে রুখে দেওয়ার সাহস করেছিলেন বলেই হয়তো ২০১৮ সালের এশিয়া কাপে লাল সবুজ জার্সিতে তামিমকে এক হাতে ব্যাট নিয়ে নেমে পড়তে দেখা গিয়েছিল।

চট্টগ্রামে ইকবাল খান সবচাইতে পরিচিত ‘ইকবাল ভাই’ হিসেবে। মনে করা হয়, খান পরিবারের এই যে খেলার প্রতি এই মোহ আর সমীহ তা আসলে এই ইকবাল ভাইয়েরই খেলার প্রতি ভালবাসার একটা অংশ, যে ভালবাসা দিয়ে তিনি বন্দর নগরীতে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিলেন ‘কেকেআরসি’ (কাজীর দেউড়ি খাজা রিক্রিয়েশন ক্লাব)। মূলত চট্টলার ইকবাল ভাই-এর এই ক্লাবটিই পরে চট্টগ্রাম আবাহনী হিসেবে নিজেদের আত্মপ্রকাশ করে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর একটা স্পোর্টস ক্লাব চালানো চাট্টিখানি কথা ছিল না। তাও ইকবাল খান করেছিলেন পারিবারিক ব্যাবসা সামলে নিজের খেলার প্রতি ঐ আকাশছোঁয়া আবেগকে পুঁজি করেই। যদি আপনি ভেবে থাকেন, ইকবাল খানের অবদান এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ তাহলে আপনার এখনও অবাক হবার পালা বাকি। ‘ইস্ট এন্ড ক্লাব’ এর সেরা স্ট্রাইকারটি তাঁর নিজের ক্যারিয়ারকেও বিসর্জন দিয়েছিলেন শুধু চট্টগ্রামে স্বাধীনতার পর খেলাধুলাটাকে ছড়িয়ে দিতে।

শুধু তাই না, এই খেলাটাকে ছড়িয়ে দেবার দায়িত্ব নেবার পর যারা ইকবাল খানের অধীনে অনুশীলন করতেন, দুপুরের খাবারে ইকবাল খান তাদের সবাইকে রাজসিক খাবার দিতেন – তার বাবার ‘খাজা হোটেল’-এ। ইকবাল খানের বাবা, মানে তামিমদের দাদা অবশ্য এসব মোটেও উদার নয়নে দেখতেন না,  তিনি বরং অন্য সব বাবার মতই চাইতেন তার ছেলের সব মনোযোগ যেন পারিবারিক ব্যবসাতেই থাকে।

সাবেক জাতীয় দলের ফুটবলার আশীষ ভদ্রকে মনে করা হয় ইকবাল খানের অধীনে বড় হওয়া সবচাইতে স্টার ফুটবলার। আশীষ ভদ্রই মনে করেন ইকবাল খান না থাকলে এই উচ্চ পর্যায়ে ফুটবল তিনি খেলতেন কিনা সন্দেহ।

তিনি বলেন, ‘তাঁর কোচিং পদ্ধতি ছিল অসাধারণ। ১৯৭৭ সালে আমি যখন ঢাকাতে আসি, তখন এখানে ড্রিল করার সরঞ্জামই ছিল না। যেটি কিনা চট্টগ্রামে ইকবাল খানের কাছে আগে থেকেই ছিল,  সেটি দিয়েই তিনি তার ফুটবলারদের অনুশীলন করাতেন। তিনি তার নিজের ক্যারিয়ার আমাদের জন্যে ত্যাগ করেছিলেন, শুধু এটুকু নিশ্চিত করার জন্যে যেন চট্টগ্রামের ফুটবলাররা জাতীয় পর্যায়ে খেলতে পারে।’

নানা অর্জনের পাশাপাশি চট্টগ্রাম মোহামেডানের অধিনায়ক ছিলেন বলে সবাই আমরা জানি ফুটবলে ইকবাল খান কতটা পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু আমরা হয়তো জানিনা, ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেটটাও বেশ ভালই খেলতেন তিনি। আশীষ ভদ্রর মতেই, ছয় নম্বরে ইকবাল খান ছিলেন বেশ কার্যকরী একজন ব্যাটসম্যান।

আশীষ ভদ্রর মুখ থেকেই শোনা যাক, ‘‘সে সময়ে তিনি ক্রিকেটে রেলওয়ে ক্লাবের হয়ে খেলতেন। ছয় নম্বরে নেমে দলের রান বাড়িয়ে নেওয়া কিংবা রানের চাকার গতি বাড়িয়ে দেওয়া, ইকবাল খান ছিলেন এদিক দিয়ে সুপরিচিত। কিন্তু ক্রিকেট ক্যারিয়ারটাও তাকে ছাড়তে হয়েছিল, কারণ তিনি আসলে যথেষ্ট সময় পেতেন না।’

ইকবাল খান ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে দীর্ঘায়িত না করলেও তার দুই ছেলে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন ক্রিকেটকেই। নাফিস ইকবাল বলেন, ‘আমাদের পরিবারের খেলার প্রতি ভালবাসাটা মূলত তাঁর থেকেই এসেছে। আমরা যে খেলার প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ একটা পরিবেশে বড় হয়েছি সেই অবদানটাও তার। তিনি ছিলেন আমাদের জন্যে এক অনুপ্রেরণা। আমি খুব বেশি সময় তার সাথে কাটাতে পারিনি। কারণ খুব অল্প বয়সেই পড়াশোনার জন্যে আমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বাবার খেলার প্রতি এই টানটা আমি ছোটবেলা থেকেই দেখেছি এবং দীর্ঘ সময় অব্দি সেটা পাল্টায়নি।’

বাবার সাথে ক্ষুদে তামিম ইকবাল

তামিম ইকবাল তার বাবাকে ভালবাসেন সবচাইতে বেশি,  নানা সময়ে নানা সাক্ষাৎকারে সেটি তিনি প্রাণখুলে বলেছেন। নিজের ক্যারিয়ারে বাবার অবদানটাও তিনি স্বীকার করেন অকপটে, ‘আমি যে একজন পরিপুর্ণ ক্রিকেটার হিসেবে খেলতে পারছি, স্বপ্ন দেখতে পেরেছি এর মূল কারণ একটাই – আমার বাবা চেয়েছিলেন।’

২০০০ এর শুরুর দিকে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান ইকবাল খান। তামিম ইকবাল বলেন, ‘আমি তখন খুব ছোট ছিলাম। কিন্তু খেলাধুলাতে বাবা সম্বন্ধে আমি যা শুনেছি,  আমার খুব ইচ্ছে হয় আমি তাকে একবার ওভাবে দেখতে পারতাম। সত্যি বলতে আমি আমার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উনাকে অনুসরণ করি। আমি কোনো সুপার হিরোতে বিশ্বাস করিনা, কিন্তু যদি আমাকে একটি নাম বলতে বলা হয়, আমি বলব আমার বাবাই আমার সুপার হিরো!’

এছাড়াও তামিম বলেন, চট্টগ্রামে খেলাধুলাকে ছড়িয়ে দিতে ইকবাল খানের যে প্রয়াস আর তাড়না তার গল্প তিনি শুনেছিলেন দাদীর কাছ থেকে, ‘আমি দাদীর থেকে শুনেছি তিনি আশীষ আংকেল সহ অনেকের জন্যেই বিদেশ থেকে জার্সি,বুট এসব খেলার সরঞ্জাম আনাতেন। এমনকি দাদার থেকে তিনি তার দলকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে সময়ে অসময়ে প্রচুর টাকা নিতেন। আমার দাদা এসবে খুশি ছিলেন না মোটেই, কিন্তু দাদী কোনভাবে এসব সামলে দিতেন।’

তামিম বলেছেন তিনি তার বাবাকে অনুসরণ করেন। কথাটা মিথ্যে নয়, তার বাবার মতই তিনি তার সময়ের ক্রিকেটারদের নানাভাবে সাহায্য করেন, ক্রিকেট পাড়ায় কান পাতলেই এর নানা উদাহরণ শোনা যায়।

ইকবাল খান বেঁচে ছিলেন ৪৯ বছর। ইকবাল খানের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের ক্রীড়া জগতে চট্টগ্রামের নামকে উঁচুতে নিয়ে যাওয়া। তা তাঁর ছেলেরা করতে পেরেছেন বলা যায়, যে কারণে ‘খান পরিবার’ এখনও বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতে আলোক মশাল ধরে সামনেই আছে। তামিমদের ব্যাটেই বেঁচে আছেন ‘ইকবাল ভাই’!

_______________

মূল লেখা: From Iqbal Khan to Tamim Iqbal: A family synonymous with sports। অনুবাদ: সামিয়াতুল  খান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link