কেনিয়া ক্রিকেটের পরিবারতন্ত্র

দু:খ এবং হতাশা মিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠেন টিটো। মনের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে কেনিয়ার ক্রিকেটের সোনালি দিনগুলোর কথা মনে করে। টিটোর আবেগটা একদম অকৃত্রিম। কেনিয়ার ক্রিকেটের বর্তমান পরিণতি তাকে কষ্ট দেয়, রাতে ঘুমোতে দেয় না। নি:সন্দেহে ভবিষ্যতে ওদুম্বে, টিকোলো, ওবুয়ারা লুকিয়ে আছে কেনিয়ায়, অপেক্ষা করছে ভবিষ্যতের কিংবদন্তি হবার। এখন কেবল ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সদিচ্ছা দরকার তাঁদের তুলে আনার।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সাড়া জাগানো দল ছিল কেনিয়া। নিয়মিত বড় দলগুলোকে হারানো এক প্রকার অভ্যাসে পরিণত করেছিল তারা। সীমিত অবকাঠামো নিয়েই দক্ষিণ আফ্রিকা এবং জিম্বাবুয়ের সাথে যৌথভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন করে তাঁরা।

সেবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুয়ের মতো দলকে হারিয়ে সেমিফাইনাল খেলে তারা। কিন্তু আর্থিক দুরবস্থার কারণে ক্রিকেট কখনোই কেনিয়ার জনমানুষের খেলা ছিল না। গুটিকয়েক পরিবারের ছেলেরাই কেবল ক্রিকেট খেলতেন। আসুন দেখে নেয়া যাক, কেনিয়ার ক্রিকেটের এসব পরিবারের সদস্যদের।

  • ওদুম্বে পরিবার

ওদুম্বে নামটা চিন্তায় আসলেই প্রথমেই মনে পড়ে মরিস ওদুম্বের কথা। কেনিয়া তো বটেই নিজের সময়ে পুরো বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি। তার ভাই টিটোর সাথে মিলে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাঙ্গন। যদিও ওদুম্বে পরিবারের আরো পাঁচ ছেলে ক্রিকেট খেলতেন। তথাপি কেবল মরিস এবং টিটোই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলতে পেরেছেন।

‘এক পর্যায়ে কেনিয়া জাতীয় দলে আমরা চার ভাই খেলেছি। আমাদের ভাই, প্রয়াত কেনেথ ওধিয়াম্বো ছিলেন কেনিয়া দলে খেলা প্রথম আফ্রিকান ক্রিকেটার। আমাদের সবার জন্য কেনেথই ছিলেন অনুপ্রেরণা’, বলেন টিটো।

তার ভাই মরিস ওদুম্বে ছিলেন কেনিয়া জাতীয় দলের অধিনায়ক। জাতীয় দলের হয়ে প্রায় দেড় হাজারের মতো রান করেছেন তিনি। এছাড়া বল হাতেও দারুণ কার্যকরী ছিলেন তিনি, ডানহাতি অফস্পিনে নিয়েছেন ৩৯ উইকেট। যদিও ২০০৪ সালে বাজিকরদের কাছে থেকে অর্থ নেবার অভিযোগে আইসিসি তাকে পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা দেয়। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ২০০৯ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটেও ফিরেছিলেন তিনি। ২০১৮ সালের এপ্রিলে কেনিয়া জাতীয় দলের কোচ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি।

  • টিকোলো পরিবার

টম, ডেভিড এবং স্টিভ টিকোলো ছিলেন কেনিয়ান ক্রিকেটের তিন স্তম্ভ। তিন ভাইয়ের মাঝে সবার বড় টম, কেনিয়ার পক্ষে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি সর্বোচ্চ ২২ টি আইসিসি ট্রফির ম্যাচে জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর মাঝে প্রথম শ্রেণির এক ম্যাচে ৭৯ রানের অনবদ্য এক ইনিংস আছে তার। ব্যাটপ্যাড তুলে রাখার পর্ব ক্রিকেটের সাথে যুক্ত ছিলেন টম। কেনিয়া জাতীয় দলের নির্বাচক থাকার পাশাপাশি বোর্ডের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন ২০০৫ সালে।

বড় ভাইয়ের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন ছোটভাই স্টিভ টিকোলো। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে কেনিয়ার অধিনায়কত্ব করেছেন স্টিভ। মরিস ওদুম্বের পাশাপাশি কেনিয়ার ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে স্টিভের নামও উচ্চারিত হয় একই কাতারে। কেনিয়ার হয়ে সর্বোচ্চ রানের পাশাপাশি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের রেকর্ড তারই।

পিটার ওনগোন্ডো, যিনি কিনা ওদুম্বে এবং টিকোলো দুজনের সাথেই ড্রেসিংরুম শেয়ার করেছেন তিনি স্টিভের নেতৃত্বগুণের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ‘টিকোলো পরিবারকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গেছে স্টিভ টিকোলো। সব সময় শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকতেন এবং কেনিয়ার অধিনায়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বড়ভাই টমের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন স্টিভ। আমার ছোটভাইও ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত খেলেছে কিন্ত জাতীয় দলে খেলার মতো যোগ্যতা অর্জন  করতে পারেনি’, বলেন ওনগোন্ডো।

খেলা থেকে অবসরের পর কোচিংকেই নিজের পেশা হিসেবে বেছে নেন স্টিভ। উগান্ডার হয়ে কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করলেও বর্তমানে তানজানিয়ার কোচ হিসেবে কাজ করছেন এই কিংবদন্তি।

  • ওবুয়া পরিবার

ওবুয়া পরিবারের ক্রিকেটারদের মতো নির্মল বিনোদন বোধহয় ক্রিকেট ইতিহাসের অন্য কোনো পরিবার দিতে পারেননি। কেনেডি, কলিন্স এবং কলিন্স ওবুয়া কেনিয়ার বিশ্বকাপ যাত্রায় অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। কেনেডি যিনি কিনা তার নামের মাঝের অংশ ওটিয়ানো নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।

২০০৩ বিশ্বকাপের মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তার ৬০ রানই জয় পরাজয়ের মাঝে ব্যবধান গড়ে দেয়। চামিন্দা ভাসের বলে রবীন্দু শাহ ফিরে গেলেও একপ্রান্ত আগলে ওটিয়ানো ছিলেন অবিচল। এছাড়া ১৯৯৬ আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলেন ১৪৪ রানের অনবদ্য এক ইনিংস যা কিনা ছিল কেনিয়ান কোনো ক্রিকেটারের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।

তার ভাই কলিন্স বুঁদ ছিলেন লেগস্পিনের মায়ায়। বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২৪ রানে পাঁচ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন তিনি। ‘পরিশ্রম আর নিষ্ঠা মানুষকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ওবুয়া ভাইয়েরা। প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভা না থাকলেও পরিশ্রম দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন কেনিয়ার ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার হিসেবে’, বলেন ওনগোন্ডো।

  • সুজি এবং নগুচে পরিবার

ওনগোন্ডো কেনিয়ার ক্রিকেটে সুজি এবং নগুচে পরিবারের কথাও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। কেনিয়ার ক্রিকেটের সেরা সময়গুলোতেও  তাদের অবদান উল্লেখযোগ্য।

‘নগুচেরা ম্যাচে আহামরি ভালো না খেললেও দারুণ একটা প্রভাব রাখতে পারতো। হয়তো ছোট কিন্তু কার্যকরী একটা ইনিংস কিংবা ম্যাচের মোড় ঘুরানো একটা উইকেট কিংবা ক্যাচ ধরে। ল্যামেক এবং নেহেমিয়া ২০১১ বিশ্বকাপে দলকে কোয়ালিফাই করার জন্য সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিল।

পরবর্তীতে শেম নগুচে তো অধিনায়কত্বই করেছেন। নিষেধাজ্ঞার আগে জেমস ছিলেন কেনিয়ার ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্পিনার। এছাড়া নগুচেদের তিন বোনও ক্রিকেট খেলেছেন। মার্গারেট নগুচে কেনিয়া প্রমীলা ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্বও করেছেন’, বলেন ওনগোন্ডো।

সুজি ভাইদের অবদানও কেনিয়ান ক্রিকেটে অনস্বীকার্য। তিন ভাই মার্টিন, ম্যাকডোনাল্ড আর টনি নিজেদের সময়ে চুঁটিয়ে খেলেছেন কেনিয়ার হয়ে। ক্যারিয়ারের গোধূলিবেলায় এসেও নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে দলকে এগিয়ে নেবার চেষ্টা করে গেছেন।

‘তাঁরা অসাধারণ ছিলেন। মার্টিন অনেক বছর যাবত কেনিয়ার পেস বোলিংয়কে নেতৃত্ব দিয়েছেন অন্যদিকে, ম্যাকডোনাল্ড ১৯৯৩-৯৪ আইসিসি ট্রফিতে দলের হয়ে বোলিং শুরু করতেন’, স্মরণ করেন তিনি।

তিনি আরো জানান মার্টিন বর্তমানে রুয়ান্ডা ক্রিকেট দলের সাথে কাজ করছেন। অন্যদিকে, ম্যাকডোনাল্ড যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আর টনি পারিবারিক ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছেন।

  • কোন পরিবার সেরা?

টিটোর মতে, পরিবারের বড় ছেলের ক্রিকেট খেলা পরের ভাইদের জন্য সহজ করে দিয়েছে। বাড়িতে ক্রিকেট খেলার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, ছোটরা সহজেই নিজেদের ভুল শোধরে নিতে পেরেছে।

‘বেশিরভাগ বাচ্চাদেরই বেড়ে ওঠা সরকারি কিংবা রেলওয়ের কোয়ার্টারে। আমরা সরকারি কোয়ার্টারে বেড়ে উঠেছি যেখানে ক্রিকেটকে তেমন গুরুত্বের সাথে দেখা হতো না’, হতাশা ব্যক্ত করেন টিটো।

তিনি আরো বলেন পরিবারের মাঝে ছোট ভাইদের ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে ওঠার ব্যাপারে সাহায্য করার প্রথাটা এখন আর দেখা যায় না, এক প্রকার বিলুপ্তই হয়ে গেছে। তিনি এজন্য কেনিয়ার সরকার এবং ক্রিকেট বোর্ডকে দোষারোপ করেন।

২০০৩ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল নিশ্চিত হওয়ার পর।

‘ক্রিকেট স্টেক হোল্ডারদের মানসিকতার পরিবর্তন আনা জরুরি। নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে কখনোই উন্নতি করা সম্ভব নয়। যথাসম্ভব পরিশ্রম করতে হবে তবেই না আপনি ভাগ্যকে পাশে পাবেন’, বলেন টিটো।

দু:খ এবং হতাশামিশ্রিত কণ্ঠে বলে ওঠেন টিটো। মনের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে কেনিয়ার ক্রিকেটের সোনালি দিনগুলোর কথা মনে করে। টিটোর আবেগটা একদম অকৃত্রিম। কেনিয়ার ক্রিকেটের বর্তমান পরিণতি তাকে কষ্ট দেয়, রাতে ঘুমোতে দেয় না। নি:সন্দেহে ভবিষ্যতে ওদুম্বে, টিকোলো, ওবুয়ারা লুকিয়ে আছে কেনিয়ায়, অপেক্ষা করছে ভবিষ্যতের কিংবদন্তি হবার। এখন কেবল ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সদিচ্ছা দরকার তাঁদের তুলে আনার।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...