মাঠ থেকে বিদায়ের সংস্কৃতি কেন জরুরী!

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে এখনও বিদায় বলা হয়নি মাশরাফি বিন মর্তুজার। আনুষ্ঠানিকভাবে সেটি না বলা হলেও বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফলতম অধিনায়কের জন্য জাতীয় দলের দুয়ার বন্ধ হয়ে গিয়েছে বছর তিনেক আগেই। জিম্বাবুয়ে সিরিজ দিয়ে সেই যে শেষ একটা সিরিজ খেলেছিলেন, এরপর লাল সবুজের জার্সি আর গায়ে নেওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাশরাফির পথচলাটা শেষ হয়ে যায় তখনই।

একটা বিদায়ী ম্যাচ অন্তত মাশরাফি পেতেই পারতেন- এই আক্ষেপ যেন সবার। বিসিবিও ঘটা করে মাশরাফিকে বিদায় দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এত বছরের ক্যারিয়ারে মাশরাফি এবারও মাথা উঁচু করে রাখলেন। এমন করুণা তিনি নিতে চাইলেন না।

বিদায়ী ম্যাচকে যে তিনি করুণার কাতারে ফেললেন, এমনটি নয়। কিন্তু খেলোয়াড় জীবনের দর্শনে মাশরাফি হয়তো ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী। যখন মনে হবে তখনই বিদায় বলবেন। এর আগে মাশরাফিকে দরকার না হলে ছেঁটে ফেলুন। কোনো সমস্যা নেই। ঘটা করে বিদায়ের জৌলুশে তিনি আকৃষ্ট নন। মাশরাফি এমন কিছুরই একটা বার্তা দিতে চাইলেন।

বিসিবিও সেই বার্তা ধরে নিয়ে পরের সিরিজের খাতা থেকে ‘মাশরাফি’ নামটা কেটে দিল। যদিও গণমাধ্যমে বারবারই এসেছে, মাশরাফি চাইলেই মাঠ থেকে বিদায় নিতে পারেন। বিসিবি সে সব কিছু বন্দোবস্ত করতে সদা প্রস্তুত। কিন্তু মাশরাফি বরাবরের মতই তাঁর ভাবনায় অবিচল। এমন আড়ম্বরপূর্ণ সাজানো বিদায় তিনি চান না।

মাশরাফি, মুশফিক, সাকিব, তামিম, রিয়াদ- বাংলাদেশ ক্রিকেটের যা একটু গতি এসেছে তা এই পঞ্চ পান্ডবের জন্যই। এটি নিয়ে বিন্দুমাত্র প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। তবে সব কিছুরই তো একটা শেষ আছে। সেই চিরন্তন নিয়ম কিংবা গতিতেই সব কিছু চলে। মাশরাফি টি-টোয়েন্টি ছেড়েছেন সেই ২০১৭ সালে।

মুশফিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ছেড়েছেন গত বছরে, একই সাথে তামিমও এই ফরম্যাটকে বিদায় বলেছেন। রিয়াদ টেস্ট ক্রিকেট থেকে বিদায় নিয়েছে বছর দুয়েক গড়ালো। বিদায় না বললেও, টি-টোয়েন্টি দল থেকে দূরেই আছেন তিনি। সব মিলিয়ে এক সাকিব ছাড়া আপাতত পঞ্চপান্ডবের কেউই এক সঙ্গে তিন ফরম্যাটের দলে নেই।

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ ক্রিকেটকে যারা এতদূর এগিয়ে নিয়ে এলেন তারা কি সবাই বিদায়ী ম্যাচ পাবে? বিসিবি সব সময়ই এ প্রসঙ্গে সরব। তবে এখানে একটা ‘কিন্তু’ আছে। সবাই কি মাঠের ক্রিকেটে স্বেচ্ছায় বিদায় নেওয়ার মত অবস্থায় আছেন? অর্থাৎ কেউ কি তাঁর ‘শেষ’ অনুধাবন করতে সমর্থ ?

এই যেমন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে এখনও অবসর নেননি। কিন্তু তিনি এখন আপাতত দলের বাইরে। ধরেই নেওয়া যায় রিয়াদের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে ফুলস্টপ বসে গেছে। এখন বিসিবি চাইলে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায়ের সুযোগ দিতেই পারে। কিন্তু এমন সাজানো মঞ্চ আসলেই মাথা নুয়ে বরণ করবেন রিয়াদ?

আবার তিনি টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় বলেছিলেন অনেকটা হুট করেই। বিসিবিও অবগত ছিল না। তাই বিদায়ী টেস্টে রিয়াদের জন্য বিশেষ কিছু করারও ছিল না। বাকি রইল ওয়ানডে ক্রিকেট। এখন টি-টোয়েন্টির মতই যদি রিয়াদ থামতে না চান তাহলে একটা সময় পর টিম ম্যানেজমেন্টকেই থামাতে হয়। আর এখানেই একটা দূরত্ব তৈরি হয় বিসিবি আর খেলোয়াড়ের মাঝে।

একই ব্যাখ্যা প্রযোজ্য সাকিব, মুশফিক, তামিমদের জন্যও। তবে টিম ম্যানেজমেন্টের সাথে ক্রিকেটারের আলোচনা সাপেক্ষে সুন্দর বিদায়ের ইতিহাস যে একেবারে নেই তা কিন্তু নয়। ভারতের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কপিল দেবকে অবসর নিতে হয়েছিল টিম ম্যানেজমেন্টের এক বার্তায়। তবে সেটি হয়েছিল অনেক সুন্দর ভাবে। কপিল দেবও ভেবেছিলেন, এখানেই থেমে যাওয়া প্রয়োজন। তাই তাঁর অবসরটাও হয়েছিল রাজকীয়ভাবে।

মোদ্দাকথা হল, দুই পক্ষের সুন্দর সমন্বয় প্রয়োজন। কিন্তু বৈপরীত্য হল, বাংলাদেশের ক্রিকেটে তা হয় না। হয় ক্রিকেটারদের জেদ, একগুয়েমিতার কারণে হয় না, নয়তো ম্যানেজমেন্টের এমন কিছুর বার্তার মাঝে ভুল থাকে।

মাঠ থেকে বিদায় নেওয়াতেই যে ক্যারিয়ারের সেরা অর্জন লুকিয়ে আছে, তেমনটি কোনোভাবেই নয়। ভারতের মহেন্দ্র সিং ধোনি টেস্ট থেকে অবসর নিয়েছিলেন ম্যাচ পরবর্তী প্রেস কনফারেন্সে এসে। আর বাকি দুই ফরম্যাটকে বিদায় বলেছিলেন এক টুইটের মাধ্যমে। মাশরাফির মত আরো অনেকের কাছেই তাই আড়ম্বরপূর্ণ বিদায় একদমই গুরুত্বহীন।

তবে মাশরাফি এমন বিদায় না নিতে চাইলেও এটা বলে এসেছেন যে, ‘বাকি চার ক্রিকেটারকে সম্মান জানিয়ে বিসিবির বিদায় জানানো উচিৎ।’ বিসিবিও এমন প্রশ্নের উত্তরে কখনোই অস্পষ্টতা তৈরি করেনি। স্পষ্টভাবেই বলেছে, তারা বরং আয়োজন করে বিদায় জানাতে পারলেই খুশি।

তবে ঘুরে ফিরে ঐ একটি কথাই চলে আসে, কোথায় থামতে হবে, সেটা জানা জরুরি। এখন এই বোধোদয় কোনো ক্রিকেটারের না হলে একটা দেশের ক্রিকেট বোর্ডকে ভিন্ন ভাবেই ভাবতে হয়। কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এখন বাকি চার ক্রিকেটারের বেলায় কেমন পরিণতি অপেক্ষা করছে সেটা সময়ের স্রোতে ঠিকই বেরিয়ে আসবে।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link