গোলরক্ষক হয়ে প্রথম নেমেছিলেন আয়তাকার সবুজ স্বর্গে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তিনি হয়েছেন অন্যতম সেরা স্ট্রাইকারদের একজন। তুলে ধরেছিলেন এ বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষনীয় ট্রফি। ছয় কেজি ওজনের সেই স্বর্ণালী ট্রফি। যা একবার হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার আকাঙ্ক্ষায় নির্ঘুম কাটে রাতে পর রাত। সে ট্রফিটায় চুমু এঁকে দিতে পেরেছিলেন ফার্নান্দো তোরেস।
স্প্যানিশ তারকা স্ট্রাইকার ফার্নান্দো তোরেসের জন্ম রাজধানী মাদ্রিদে। সময়টা তখন ১৯৮৪ সাল। ২০ মার্চ জন্মেছিলেন তোরেস। পুরো নাম ফার্নান্দো হোসে তোরেস সাঞ্জ। ফুটবলের সাথে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর দাদু। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই ফুটবল মাঠে আনাগোনা শুরু তোরেস নামক শিশুর। দাদু ছিলেন অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদের ভক্ত। আর সে থেকেই হয়ত ফুটবলের পাশাপাশি অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে খুব ভালবেসে ফেলেছিলেন।
টুকটাক ইনডোর ফুটবল খেলা শুরু করা তোরেস সাত বছর বয়সেই স্ট্রাইকার হিসেবে খেলা শুরু করেন। স্থানীয় এক ক্লাবের হয়ে এক মৌসুমে ৫৫ গোল করে আলোচনায় এসে যান ক্ষুদে তোরেস। তাঁর ফুটবলীয় শৈলী এবং তাঁর গোল করার দক্ষতায় বেশ মুগ্ধ হয় অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের অ্যাকাডেমির কর্তারা। ব্যাস, সেখান থেকেই শুরু অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সাথে তোরেস প্রেমকাব্য।
যুব দল থেকে শুরু করে নিজেকে ক্রমশ পরিণত করে তিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের মূল দলে। তবে অপেক্ষার প্রহর বেশ খানিকটা লম্বাই হয়েছিল। ১৫ বছর বয়সে প্রথম পেশাদার চুক্তি সাক্ষর করেছিলেন তোরেস।
এরপর যুবদলে খেলেছেন, মূল দলের সাথেও অনুশীলন করেছেন তিনি। তবে প্রথমবারের মতো অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে তিনি মাঠে নেমেছিলেন ২০০১ সালে লেগানেন্সের বিপক্ষে। লাল-সাদা জার্সিটা গায়ে জড়িয়ে এরপর তিনি মাঠে নেমেছেন অসংখ্যবার।
প্রথম দফায় ২৪৪ ম্যাচ খেলেছেন মাদ্রিদের হয়ে। এ সময় লাল-সাদা জার্সি গায়ে জড়িয়ে বলকে জালের ঠিকানায় পাঠিয়েছেন ৯১ বার। এরপর একটু বদলের প্রয়োজন ছিল তাঁর। নিজের সামর্থ্যকে আরেকটু বাজিয়ে দেখার প্রয়োজন ছিল। তাই তিনি শৈশবের ক্লাবের মায়া ছেড়ে চলে গেলেন লিভারপুলে।
স্পেন থেকে পাড়ি জমালেন ইংল্যান্ডে। সে সময়ের রেকর্ড পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে অল রেড শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন তোরেস। তাঁকে দলে ভেড়াতে নাকি প্রায় ৪০মিলিয়ন ইউরো খরচ করেছিল ইংলিশ ক্লাব লিভারপুল। সে অর্থ যে যথাযথ ব্যবহার হয়েছে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।
প্রথম মৌসুমেই তিনি ৩৪টি গোল করে বসেন অল রেডদের হয়ে। সুদক্ষ এক স্ট্রাইকার হওয়ার জন্য তাঁর সবকিছুই নিজের মধ্যে ধারণ করতেন তোরেস। গতি, ভিশন, দক্ষতা, ফুটবলীয় কারিকুরি সব কিছুরই দেখা মিলেছে তাঁর মধ্যে। একজন জাত স্ট্রাইকার বলতে যা বোঝায়।
সব সময় হন্যে হয়ে সুযোগ খুঁজবে গোল দেওয়ার। যখনই সুযোগ আসবে তখনই কোন রকমের ভুলচুক না করেই বল জালে জড়াতে তৎপর তোরেস। ফুটবল ক্যারিয়ারে নানান চড়াই-উতরাই পার করেছেন তবুও একেবারেই নিভে যাওয়া প্রদীপে কখনোই পরিণত হননি তোরেস। অর্জনের ঠাসা ক্যারিয়ারে লিভারপুল কিংবদন্তি হয়ে বেঁচে রইবেন তিনি। ক্লাবটি হয়ে দ্রুততম সময়ে ৫০ গোল করেছিলেন তোরেস।
লিভারপুলের সাথেও সময়টা দারুণ কাটে তাঁর। যদিও দলগত অর্জনের খাতাটা একেবারেই শূন্য। বেশ খানিকট জল ঘোলা করে আরেক ইংলিশ ক্লাব চেলসিতে যোগ দিয়েছিলেন ফার্নান্দো তোরেস। যদিও গোপন এক অর্থচুক্তিতে তিনি নাম লিখিয়েছিলেন চেলসিতে। তবে ধারণা করা হয় প্রায় ৫০ মিলিয়ন পাউন্ডে তাঁকে দলে নিয়েছিল চেলসি। সেখানে এসে যেন ভাগ্য সহায় হতে শুরু করে তোরেসের।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ইউরোপা লিগ ও এফ এ কাপের শিরোপা যুক্ত হয় তোরেসের অর্জনের আলমারিতে। এরই মাঝে একজন ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে সবচেয়ে বড় অর্জনটা যুক্ত হয়ে গিয়েছিল তাঁর নামের পাশে। ২০১০ সালে আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হওয়া ফুটবল বিশ্বকাপের তারকায় ঠাসা স্পেন দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়েই তিনি জিতেছিলেন স্পেন ও নিজের ফুটবল জীবনের প্রথম ও এখন অবধি একমাত্র বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপ ছাড়াও উয়েফা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের দুইবারের শিরোপা নিজের হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ হয়েছিল ফার্নান্দো তোরেসের। দলগত অর্জনের মাঝে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির সাথে তাল মিলিয়ে তাঁর পারফরমেন্সের গ্রাফ হয়েছে নিম্নগামী। চেলসি থেকে এক মৌসুমের জন্য ধারে খেলতে ইতালির ক্লাব এসি মিলানের জার্সিও গায়ে জড়িয়েছিলেন তোরেস। সেখান থেকে আবার নিজ ঘরে।
আবার সেই চিরচেনা মাদ্রিদ শহরে। যেখানে বেড়ে ওঠা, যেখানে আবার ফিরে যাওয়া। প্রথমে ধারে এরপর পুরোপুরি। দ্বিতীয় দফা একেবারে ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে তিনি যোগ দিয়েছিলেন মাদ্রিদের ক্লাবটিতে। সেখানে ১৬০ ম্যাচে তাঁর গোল সংখ্যা ৩৮। তবে সবচেয়ে আপন ভাবা ক্লাবটির হয়ে তাঁর অর্জন নেহায়েত হাতে গোনা। উয়েফা ইউরোপা কাপ ছাড়া বলার মত অর্জন উয়েফা চ্যাম্পিইন্স লিগের রানার্স আপ।
মাদ্রিদ ছেড়ে জাপান গিয়ে শেষমেশ তিনি তাঁর খেলোয়াড়ী জীবনের ইতি টেনে নেন। ২০১৯ মৌসুমে শেষ সবুজ মাঠে কাটাওয়ালা জুতো পরে নেমেছিলেন তোরেস। ততদিনে তাঁর ক্লাব ক্যারিয়ারে গোলের সংখ্যা ২৬২। অন্যদিকে, স্পেন জাতীয় দলের হয়ে ৩৯টি গোল করেছিলেন তোরেস। স্পেনের জার্সিতে তিনি যেন এক ভিন্ন তারকা। জাতীয় দলের সব বড় অর্জনেই ছিল তাঁর হাত।
খেলোয়াড়ী জীবনের ইতি টেনে এখন তিনি মনোযোগ দিচ্ছেন কোচিং ক্যারিয়ারে। শৈশবের ক্লাব অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের যুব দলের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি বর্তমানে। শৈশবের ক্লাব আর ফুটবলের মায়া কি এত সহজেই ঝেড়ে ফেলা যায় ? এ যে এক বিশাল বড় দায়!