মদনলালের নদীর জীবন

বলের গতির চাইতে রানআপ গতিশীল। ভারতের বিশ্বকাপ জয়ী অলরাউন্ডার মদন লাল-কে ঘিরে এমনই এক কথা প্রচলিত ছিল তাঁর সময়ের ভারত দলে। বল করার আগে খুব দ্রুত ছুটে যেতেন বলেই হয়ত এমন বাক্যের প্রচলন। তবে মদন লালের দৌড় কিংবা বল যেটাই গতিশীল হোক না কেন, তিনি ছিলেন একজন কার্য্যকর অলরাউন্ডার।

বলের গতির চাইতে রানআপ গতিশীল। ভারতের বিশ্বকাপ জয়ী অলরাউন্ডার মদন লাল-কে ঘিরে এমনই এক কথা প্রচলিত ছিল তাঁর সময়ের ভারত দলে। বল করার আগে খুব দ্রুত ছুটে যেতেন বলেই হয়ত এমন বাক্যের প্রচলন। তবে মদন লালের দৌড় কিংবা বল যেটাই গতিশীল হোক না কেন, তিনি ছিলেন একজন কার্য্যকর অলরাউন্ডার।

২০ মার্চ ১৯৫১ সালে জন্মেছিলেন ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের দূর্দান্ত ক্রিকেটার ও ১৯৮৩ বিশ্বকাপের নায়ক মদন লাল উধুরাম শর্মা। পরবর্তীতে মদন লাল কিংবা ‘মাদ্দিপা’ হিসেবেই যার বিচরণ ক্রিকেটাঙ্গনে। তবে তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা শুরু স্কুল জীবনের। পড়াশোনার পাশাপাশি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সবুজ মাঠ। শিক্ষাজীবনেই ক্রিকেটে আলো ছড়িয়েছেন।

সে আল ছিল বেশ প্রখর। তাইতো ১৯৬৮/৬৯ মৌসুমের রঞ্জি ট্রফিতে তরুণ ক্রিকেটার হয়ে নাম লেখান পাঞ্জাব দলে। নিজের তৃতীয় রঞ্জি ম্যাচেই আটটি উইকেট বাগিয়েছিলেন মদন লাল। এরপর দিল্লীর বিপক্ষে ছিল গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। সে ম্যাচ তিনি নজর কেড়েছেন ৭৩ রানে পাঁচ উইকেট নিয়ে। অগ্রযাত্রা ক্রমশ চলমান।

বেশ কয়েকটি মৌসুম তিনি কাটিয়েছেন পাঞ্জাবের হয়ে। এরপর নতুন চ্যালেঞ্জ খুঁজে নিতে চলে যান রাজধানীর দল দিল্লিতে। তাঁর ভাল পারফর্মেন্সের একটা গল্প তখন ভারতের ক্রিকেটে ছড়িয়ে পড়া সুগন্ধ। দীলিপ ট্রফির জন্যেও তাই দল পেয়ে যান তিনি। নর্থ জোনের হয়ে প্রথমবার তিনি অংশ নেন দীলিপ ট্রফিতে। সেখানেও নিজের পারফর্মেন্সের ধারা অব্যাহত রেখে তিনি জায়গা করে নেন ভারত জাতীয় দলে।

তবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত কোন সিরিজ নয়, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রস্তুতিমূলক এক টেস্ট সিরিজে মদন লাল যুক্ত হয়েছিলেন জাতীয় দলের সাথে। প্রথম ম্যাচেই দূর্দান্ত ছিলেন তিনি। নিয়েছিলেন দশ উইকেট, খরচ করেছিলেন মাত্র ১০২ রান। ব্যাস! তাতেই খুলে যায় তাঁর ভাগ্য। এবার একেবারে আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলার নিমন্ত্রণ আসে তাঁর।

সুদূর ইংল্যান্ডে যাবেন তিনি। ১৯৭৪ সালের সেই সফরের প্রস্তুতি ম্যাচে বেসগ ভাল বল করেছিলেন মদন লাল। কাউন্টি দলের সাথে প্রথম ম্যাচ ৯৫ রান দিয়ে নেন সাত উইকেট। এরপর পরবর্তী দুই ম্যাচেও ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন তিনি। এরপর আর জাতীয় দলের দরজাটা বন্ধ থাকার কোন প্রশ্নই আসে না।

ইংল্যান্ডে ম্যানচেস্টারে অবস্থিত ওল্ড ট্রাফোর্ড স্টেডিয়ামে অভিষেক হয় তাঁর। শুরুটা তুলনামূলক ভালই করেছিলেন মদনলাল। ৫৬ রানে দিয়ে দুই উইকেট শিকার করেন। ওল্ড ট্রাফোর্ডের সবুজ পিচে দূদার্ন্ত এক শতক হাঁকান ভারতের আরেক কিংবদন্তি সুনিল গাভাস্কার। তবে বাকি ব্যাটাররা খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি।

তবে মাইক হেনড্রিকের ভুতুড়ে এক বলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই আউট হয়ে প্যাভিলনের ফিরেছিলেন মদনলাল। অফস্ট্যাম্পের বল অদ্ভূত ভাবে উপড়ে ফেলে অফ ও লেগ স্ট্যাম্প। হতভম্ব মদনলাল দাঁড়িয়ে দেখে শুধু মিডল স্ট্যাম্পটাই ছিল স্বস্থানে। ব্যাট হাতে ওমন বাজে শুরুর পর পুরো সিরিজে আর নিজেকে ফিরে পাননি মদনলাল। স্বাভাবিকভাবেই দল থেকে ছিটকে যান তিনি। শুরুতেই হোঁচট।

কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রায় দশ হাজারের বেশি রান ও ৬২৫ উইকেট শিকার করা মদনলাল তো আর এক হোঁচট খেয়েই পথ ছেড়ে পালানোর লোক নন। তিনি ছিলে লড়াকু। তিনি লড়েছেন, নিজের জায়গা পোক্ত করেছেন দলে। যদিও ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে সুযোগ হয়নি তাঁর। ০-২ এ পিছিয়ে থাকা ভারত কলকাতা টেস্টের আগে তলব করে মদনলালকে।

এসেই নিজের ঝলক দেখাতে শুরু করেন মদনলাল। ১০ বাউন্ডারির কল্যাণে শেষের দিকে নেমে ৪৮ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন। এরপর আবার বল হাতে ক্যারিবিয়ানদের চার উইকেট তুলে নেন ২২ রান দিয়ে। এমন পারফর্মেন্সের পর চতুর্থ টেস্টে তাঁর দলে থাকা ছিল নিশ্চিত। যদিও সে ম্যাচে তিনি উইকেটের দেখা পাননি। শেষ ম্যাচে তাই দলে জায়গা হয়নি তাঁর। শেষমেশ সে সিরিজ ২-৩ ব্যবধানে হেরেছিল ভারত।

তবে ‘মাদ্দিপা’য়ের অলরাউন্ড পারফর্মেন্স নির্বাচকদের বাধ্য করে তাঁকে ১৯৭৫ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া বিশ্বকাপ দলে নিতে। আর এতেই বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে নিজের নামটি লিখিয়ে ফেলেন মদনলাল। প্রথম বোলার হিসেবে বিশ্বকাপের মঞ্চে বল করেন মদনলাল। সম্ভানাময়ী এই বোলারের জাতীয় দলে ক্যারিয়ারটা একটু সরু হতে থাকে।

তাই তিনি আবার মনযোগ দেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। শুরুতেই ২২৩ রানে বিশাল এক ইনিংস খেলেন তিনি রাজস্থানের বিপক্ষে। এর বছর বাদেই রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে কর্ণাটকের বিপক্ষে ৮০ রানে আট উইকেট নিয়ে শিরোপা জেতান মদনলাল। ঘরোয়া ক্রিকেটে হয় ব্যাট না হয় বল হাতে তিনি ম্যাচের মোর ঘুরিয়ে দিতে ছিলেন পটু। তিনি দলে থাকা মানেই যেন ছিল বাড়তি এক সাহস।

ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর ধারাবাহিক পারফর্মেন্স তাঁকে আবার নিয়ে আসে জাতীয় দলের সন্নিকটে। যার সুবাদে তিনি ১৯৮৩ বিশ্বকাপ দলেও জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন। আর এরপর যা ঘটেছে তা তো সবার জানা। এরপরের পুরোটুকুই তো এক রুপকথা ভারত ক্রিকেটের। সে বিশ্বকাপ জয়েও ছিল মদনলালের প্রত্যক্ষ অবদান।

তিনি ছিলেন ভারতের দ্বিতীয় সেরা উইকেট শিকারি। ১৬.৬৬ গড়ে নিয়েছিলেন ১৭টি উইকেট। তাঁর উপরে ছিলেন কেবল রজার বিনি ১৮ উইকেট নিয়ে। তাছাড়া ব্যাট হাতেও তিনি বেশ কয়েকবার দলের হয়ে ইনিংস খেলার পাশাপাশি বড় জুটি গড়ে চাপ কমানোর চেষ্টাটা করেছেন। শেষমেশ দলগত পারফর্মেন্সে ইতিহাস লেখা হয়েছিল তাঁদের হাতে।

জাতীয় দলে আসা যাওয়ার মাঝেই ছিলেন মদনলাল। তিনি যখনই তিনি সুযোগ পেয়েছেন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। নিরাশ করেছেন পরক্ষণেই নিজের সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে দিয়ে দলকে জয়ের বন্দর অবধি নিয়ে গেছেন। জোয়ার-ভাটার মতই ছিল তাঁর জাতীয় দলের ক্যারিয়ার। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি ছিলেন ধারাবাহিক।

রান করা কিংবা উইকেট নেওয়া, সব কাজেই সুদক্ষ মদনলাল। তিনি তাঁর দলকে কতবার যে শিরোপার খুব কাছে নিয়ে গিয়েছেন তাঁর হিসেব কষে বলা মুশকিল। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র তিনি। তবে তাই বলে যে একেবারেই অন্ধকারাচ্ছন্ন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারও পার করেননি মদনলাল।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...