৫ মে, ১৯৯৮; স্টোক সিটির মাঠেই স্টোকের বিপক্ষে নেমেছে ম্যানচেস্টার সিটি। লক্ষ্য একটা বড় জয়, নইলে; নইলে ম্যানচেস্টারের ছোট্ট ক্লাবটাকে নেমে যেতে হবে সেকেন্ড ডিভিশন থেকেও। ৫-২ গোলের জয়ও তাদের স্বস্তি দিলো না। শেষমেশ তাদের নেমেই যেতে হলো দ্বিতীয় ডিভিশনে।
৫ মে, ২০২১; প্যারিসের পার্ক দ্য ফ্রান্সে একটা ড্রই যথেষ্ট তাঁদের জন্য। ইউরোপের সবচেয়ে বড় শিরোপার ফাইনাল ছোঁয়ার জন্য। রিয়াদ মাহরেজ দিনটা রাঙিয়ে দিলেন নিজের মতন করে। ম্যানচেস্টার সিটিকে পৌঁছে দিলেন ফাইনালে। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে!
২০০৮ সালে যখন আরব প্রিন্স শেখ মনসুর ম্যানচেস্টার সিটি কিনে নেন, তখন তার আগ্রহের কমতি ছিল না। প্রথমে তার নজর বড় দলের দিকেই ছিল, বড় দলের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে জেতার আনন্দ অন্যরকম। কিন্তু একটা ছোট দলকে নিয়ে তার প্রতিটা পদক্ষেপে একে একে করে সাক্ষী হয়ে জেতানোর আনন্দ অন্যরকম। ম্যানচেস্টারে তখন ক্লাব বলতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
স্যার অ্যালেক্সের অধীনে ম্যানচেস্টার তখন লাল, আর প্রিমিয়ার লিগ তখনও জমজমাট। ইউনাইটেড, আর্সেনাল, লিভারপুল, চেলসির মাঝে ম্যানচেস্টার সিটি ছিল নগন্য। তখন থেকেই সিটি সমর্থকদের মোটো ছিল একটাই, ‘ইতিহাস না থাকলে ইতিহাস তৈরি করো।’
ইতিহাস তৈরি করার লক্ষ্যেই নেমেছিল সিটি। পার্ক দ্য ফ্রান্সে সিটির জন্য সবটা তৈরিই ছিল। প্রথম লেগে নাভাসের বড় ভুল সিটিকে দিয়েছিল ১ গোলের লিড। এবার শুধু লিডের উপর নিজেদের আধিপত্য দেখানোর পরীক্ষা। পরীক্ষাটা শুধু সিটির নয়, ছিল পেপ গার্দিওলারও। ১০ বছর আগে শেষ ফাইনাল খেলেছিলেন গার্দিওলা।
এরপর বার্সা ছেড়েছেন, সেই সাথে ইউরোপে আধিপত্যও। ‘মেসি-জাভি-ইনিয়েস্তার উপরেই ভর করে ইউরোপে সাফল্য পেয়েছেন পেপ’ কথাটা ভুল করা বেশ প্রয়োজনীয় ছিল তার জন্য। বায়ার্নকে নিয়ে তিন মৌসুম ইউরোপে ছিলেন, সেমিতে কাঁটা পরেছেন স্প্যানিশ দলের কাছে। একবার রিয়াল, একবার বার্সা আরেকবার অ্যাটলেটিকো। মৌসুমের মাঝপথে তাকে পরবর্তী মৌসুমের জন্য সিটির দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন শেখ মনসুর। কারণ একটাই, একসময়ের ইউরোপ জেতা কোচকে এনেছেন সিটিকে ইউরোপজয়ী করতে।
গার্দিওলা সিটির দায়িত্ব নিয়েছিলেন ইউরোপের সিটির সেরা মৌসুমে। ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনি খোলস পাল্টে দিয়েছিলেন সিটির। যে সিটি আগে ঘুরে বেড়াতো ইউরোপের মাঝামাঝি, সেখানে পেলেগ্রিনি প্রথমবারের মতন সিটিকে খেলিয়েছিলেন সেমি ফাইনাল।
ভাগ্য সহায় থাকলে হয়তো সেই মৌসুমেই হয়তো ফাইনাল খেলার সৌভাগ্য হতো তাদের। কিন্তু ভাগ্য সেবার ছিল রিয়ালের পক্ষে। দুই লেগে মাত্র ১ গোল হজম করেছিলেন পেলেগ্রিনি, সেটাও ফার্নান্দিনহোর আত্মঘাতী গোল। কিন্তু সিটির প্ল্যানে ছিলেন না পেলেগ্রিনি। তাই দলকে নিয়ে ইউরোপের সেরা চারে গিয়েও তাঁকে বাদ পরতে হয়েছিল গার্দিওলার কাছে। আর সেই থেকে গার্দিওলার সিটটাও বেশ নড়বড়ে।
ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনির আগে সিটিতে ইউরোপের বার সেট করা ছিল না। সেটাই যাওয়ার আগে সেট করে দিয়ে গিয়েছিলেন পেলেগ্রিনি। গার্দিওলার কাছে তাই প্রত্যাশা ছিল সেই বাঁধা পার করে নতুন ইতিহাস তৈরি করা। কিন্তু গার্দিওলা ইউরোপে এসেই নিজের খেই হারিয়ে ফেলতেন।
ইংলিশ লিগে ঠিকই রেকর্ড পয়েন্টে লিগ জিতেছেন, ইতিহাস গড়েছেন ব্যাক টু ব্যাক লিগ জিতে। কিন্তু ইউরোপিয়ান সিংহাসনের যে স্বপ্ন শেখ মনসুর নিজের মনের মধ্যে পুষে রেখেছন, সেই স্বপ্নে এগুনো হচ্ছিল না।
প্রথম মৌসুমে না হয় সময় দেওয়া গিয়েছে, কিন্তু দ্বিতীয় মৌসুম থেকে পেপ গার্দিওলার সকল অংক এসে গোল পাকিয়ে যাচ্ছিল কোয়ার্টার ফাইনালেই। ২০১৭-১৮ তে প্রথম যেবার কোয়ার্টারের মুখ দেখলেন সেবার ক্লপের সামনে উড়ে গিয়েছিল পেপ, তার দলকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি মাঠে। দুই লেগ মিলিয়ে ১-৫ গোলের হার নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল তাকে।
পরের মৌসুম ২০১৮-১৯ এ আরেক ইংলিশ ক্লাব এসে দাঁড়িয়েছিল তাদের সামনে, টটেনহ্যাম হটস্পার্স। নিজেদের মাটিতে একসময় ৩ গোল এগিয়ে সেমিতে এক পা দিয়েই রেখেছিল তারা। অথচ শেষমুহূর্তে এসে এক গোল খেয়ে পুরো সমীকরণই পালটে দিয়েছিলেন মাউরিসিও পচেতিনো। ম্যাচ হেরেও অ্যাওয়ে গোলের হিসেবে বিজয়ীর বেশে মাঠ ছেড়েছিলেন তিনি।
গত মৌসুমে ছিল সূবর্ণ সুযোগ। রিয়ালকে হারিয়ে এক পা দিয়েই রেখেছিল কোয়ার্টারে। কোভিডের কারণে যখন সব এক লেগে নক-আউট করে দেওয়া হলো তখন স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলেছিলেন অনেকেই। গার্দিওলা তালগোল পাকিয়ে ফেলেন দ্বিতীয় লেগেই। এবার হয়তো এক লেগেই খেলায় নিজের সেরাটা দেখাতে পারবেন। কিন্তু সেই আগের অবস্থাই। এবার আর ইংলীশ দল না, গার্দিওলা কাঁটা পরলেন ফ্রেঞ্চ ক্লাব লিঁওর কাছে। পর্তুগালের মাটিকে একাই মৌসা ডেম্বেলে ধ্বংস করে দিলেন পেপ গার্দিওলাকে। অপেক্ষার প্রহর শুধু বাড়িয়েই চলেছেন।
গার্দিওলার বিপক্ষে কথা না উঠার কারণও ছিল না, সিটি দল গড়ার জন্য প্রায় ১ বিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি খরচ করা শেষ তার। পেলেগ্রিনির রেখে যাওয়া দল থেকে এখনও আছেন শুধু আগুয়েরো আর ফার্নান্দিনহো। বাকি সকলকেই বেশ চড়া দামে কিনে এনেছেন তিনি।
তার বেঞ্চে থাকে ৬০ মিলিয়ন ইউরোর খেলোয়াড়, প্রয়োজন বেঞ্চ থেকে নেমে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তবুও গার্দিওলার ম্যাজিক কাজ করছিল না কারোর উপরেই। অন্তত ইউরোপে তো নাই-ই। টানা তিনবার কোয়ার্টারে কাঁটা পরা বেশ আশ্চর্যজনকই। ফলে পেপ গার্দিওলাকে কথা শুনতেই হতো।
তবে শেষমেশ পেপ গার্দিওলা পেরেছেন, প্রায় ১০ বছরের অপেক্ষা কাটিয়ে পেপ গার্দিওলা অবশেষে ফাইনালে নাম লিখিয়েছেন। চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার বাধা পেরোতে হয়রান হয়ে গিয়েছিল সিটি, সেই অবস্থাটা কেটে গিয়েছে। গার্দিওলার অধীনে প্রতি মৌসুমেই ঈগিয়ে যাচ্ছিল সিটি, ঘরোয়া প্রতিযোগীতাতে জিতেছেন কিন্তু ইউরোপে জেতা হচ্ছিল না। কিন্তু গার্দিওলা পেরেছেন। এই পচেত্তিনোর কাছেই এগিয়ে থেকে কাঁটা পরেছিলেন তিনি। এবার তাকেই ট্যাক্টিক্যালি বিট করে ফাইনালে পা রেখেছেন তিনি।
অপেক্ষার পালা ফুরিয়েছে গার্দিওলার, ম্যানচেস্টার সিটিরও। সিটিতে যখন প্রথম এসেছিলেন, সার্জিও আগুয়েরো গর্ব করে বলেছিলেন, আমি চ্যাম্পিয়নস লিগ না জিতে সিটি ছাড়ছি না। মৌসুম শেষে সিটি ছাড়ার আগে সিটি লিজেন্ডকে চ্যাম্পিয়নস লিগ দিয়ে সাজিয়ে দিতে নিশ্চয় কার্পণ্য করবে না। অপেক্ষা শুধু ২৯ তারিখের, ইস্তাম্বুলে!