ফিনিশার ও সাত নম্বর পজিশনের গল্প

সাদা চোখে, একজন ফিনিশার ছয়-সাত নম্বরে ব্যাটিং করেন, বেশিরভাগ সময় সাত নম্বরে। তাঁর থেকে সাধারণত কেউ বড় ইনিংস আশা করেন না, মূল দায়িত্ব ইনিংসের শেষ দিকে দ্রুত কিংবা ইফেক্টিভ ওয়েতে রান তুলে দলকে বড় স্কোরের পথে নিয়ে যাওয়া কিংবা রান তাড়া করায় সাহায্য করা। অধিকাংশ ক্রিকেটভক্ত এই উত্তরই দিবেন।

অস্বীকার করার উপায় নেই, নিদেনপক্ষে, টি-টোয়েন্টি যুগ শুরুর আগ পর্যন্ত ফিনিশারের ধারণা এমনই ছিলো। প্রথম দিকের ব্যাটসম্যানরা রান তোলার থেকে উইকেটে থাকাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। প্রথম ৩০ ওভারে যত কম সংখ্যক উইকেট খুইয়ে ১০০-১২০ রান তোলা যায়, সেটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শেষ ২০ ওভারে ধুন্ধুমার ব্যাট চালিয়ে ১৪০-১৬০ রান তুলতে পারলে বেশ বড়সড় স্কোর দাড়িয়ে যেত।

২৩০-২৪০ রান তখন লড়াকু স্কোর, ২৬০ এর উপরে হলে তো প্রায় জিতেই গিয়েছেন। ফিনিশারদের দায়িত্ব ছিলো এই শেষ ২০ ওভারের রানটুকু তুলে দেয়া। সাধারণত, সব দলের ফর্মুলাই এমন ছিল। আব্দুল রাজ্জাক, জ্যাকব ওরাম, অ্যালবি মরকেলরা ছিলেন হটকেকের মত।

ব্যতিক্রমের জায়গাও ছিল। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড নতুন টোটকা নিয়ে হাজির হয়েছিল। প্রথম ১০ ওভারে সবাই যখন উইকেটে থিতু হওয়ার জন্য খেলছে, তারা মার্ক গ্রেটব্যাচকে পাঠালেন ফিল্ড রেস্ট্রিকশনের সুবিধা নিয়ে দ্রুত রান তোলার জন্য। এই টোটকা কাজে লাগিয়ে নিউজিল্যান্ড সেমি ফাইনালে পৌছে গিয়েছিলো। ইনজামামের একক দানবীয় ব্যাটিং নৈপুণ্যে সেমি ফাইনাল হারলেও ক্রিকেট বিশ্ব সেবার এক নতুন স্ট্র‍্যাটেজি দেখেছিলো।

১৯৯৬ এর বিশ্বকাপে একইভাবে সনাথ জয়াসুরিয়া এবং রমেশ কালুভিতারানাকে ব্যবহার করে শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপই জিতে নিয়েছিলো। ফাইনালে অরভিন্দ ডি সিলভা সেঞ্চুরি করে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, অরভিন্দ শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের সেরা ফিনিশার। তিনি নি:সন্দেহে দ্রুত রান তুলতে পারতেন কিন্তু তাঁর ব্যাটিং পজিশন? তিনি কি ৬-৭ নম্বরে ব্যাটিং করতেন?

এরপরে ক্রিকেট দেখল অস্ট্রেলিয়ানদের গোল্ডেন জেনারেশন। টানা চারটা বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছে এই দল, টানা তিনটা বিশ্বকাপ জিতেছে। মার্ক ওয়াহ, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ম্যাথু হেইডেন, রিকি পন্টিংরা প্রথম থেকেই দ্রুত রান তোলায় বিশ্বাসী। কেবল এই দলের বিপক্ষেই ২৬০ রান অনেক বড় স্কোর মনে হত না কিন্তু ২৬০ রান করতে পারা অনেক বড় মনে হত। দলের ফিনিশারের নাম মাইকেল বেভান, সম্ভবত সর্বকালের সেরা দুই ফিনিশারের একজন তিনি।

সেরা ক্রিকেট খেলেছেন চার এবং ছয় নম্বর ব্যাটিং পজিশনে। কিন্তু পাওয়ার হিটিংয়ের মাধ্যমে দ্রুত রান তোলার কথা যদি বলেন, সেটা বেভানের মূল অস্ত্র ছিল না। চার নম্বর ব্যাটিং পজিশনে ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট ৬৯, ছয় নাম্বার পজিশনে স্ট্রাইক রেট ৭৭! তারপরেও তিনি সর্বকালের সেরা ফিনিশারদের একজন।

ফিনিশার সম্পর্কিত আমাদের ধারণার সাথে ক্রিকেটের পার্থক্য এতখানিই। আমাদের ক্রিকেটটাও এখানেই আটকে আছে। যেমনভাবে, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট অ্যালবি মরকেলের ফিনিশিংয়ের উপরে আটকে গিয়েছিলো, ইংল্যান্ডের পুরো ক্রিকেটটা আটকে গিয়েছিলো বাটলারের উপরে।

ফিনিশারকে সাত নম্বরেই ব্যাটিং করতে হবে, তাকে পাওয়ার হিটারই হতে হবে, এই ক্রিকেটীয় ধারণা ২০০৭ সালে শেষ হয়ে গিয়েছে। ধোনির সেরা ব্যাটিং পজিশন ৫-৬, এবি ডি ভিলিয়ার্সের ৪-৫ (কখনোই সাত নম্বরে ব্যাটিং করেন নি), ডি সিলভার ৪ নাম্বার, বিরাট কোহলির ৩ নম্বর, তারপরেও তারা সেরা ফিনিশার। জশ ব্যাটলার ওয়ানডেতে ছয় নম্বরে ব্যাটিং করেন কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে ওপেন করেন যেন আরো বেশি বল খেলতে পারেন।

টি-টোয়েন্টিতে তার রোলের পরিবর্তন ঘটে না, তিনি ফিনিশারই থাকেন, কেবলমাত্র তাকে ৩০ বলের পরিবর্তে ১২০ বল খেলার সুযোগ দেয়া হয়। এমনকি আমাদের নিজস্ব ফিনিশার নাসির হোসেনও ৭ নাম্বারে ব্যাটিং করে ফিনিশার তকমা পান নাই, সেরা ব্যাটিং পজিশন ছিলো ছয় নম্বর এবং তিনি পাওয়ার হিটার ছিলেন না।

ক্রিকেটে দলগুলো নিজেদের ব্যালান্স অনুযায়ী প্রতিটা পজিশনে খেলোয়াড় নিয়ে সাজায়। আপনার দলে উপরের সারির সব ব্যাটসম্যানরা পাওয়ার হিটার, সেক্ষেত্রে ব্যালান্সের জন্য আপনি মিডল অর্ডার বা লোয়ার মিডল অর্ডারে এমন একজন ব্যাটসম্যান চাইবেন যিনি আকস্মিক বিপর্যয় হলে খেলাটা হোল্ড করতে পারেন। আবার, প্রথম দিকে অ্যাংকর রোল প্লে করা ব্যাটসম্যান থাকলে, আপনি চাইবেন শেষ দিকে দ্রুত রান তোলার মত ব্যাটসম্যান।

ফিনিশিং যে কোন পজিশনে থেকেই করা যায়। গত দুই-তিন বছরে আমাদের দলের সেরা ফিনিশার মুশফিক। একারণে তাকে ৭ নম্বরে ব্যাটিং করতে হয় নি, করানোর দরকারও নেই। আপনার কেবল নির্ধারণ করা দরকার সাত নম্বর পজিশনে আপনি কেমন ধরনের খেলোয়াড় চাচ্ছেন, সেই অনুযায়ীই আপনার সবথেকে যোগ্য খেলোয়াড়টিকে। টিমের ব্যালান্সটা ঠিক করে নিলে বাকিটা ঠিক হওয়া কঠিন কিছু নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link