ভারতের প্রথম সুপারস্টার

বোম্বের জিমখানা মাঠের আশেপাশে আজ তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কিছু না হলেও হাজার চারেক লোক তো জড়ো হয়েইছে। একপাশে বাঁশটাঁশ খাটিয়ে প্রকাণ্ড ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। একদিকে কাঠের গ্যালারি। মাঠের বাকি দু’পাশ ঘেরা মোটা দড়ি দিয়ে। চা-চানাচুর-মুড়ি মুড়কির বিক্কিরি আজ তুঙ্গে।

বোম্বের জিমখানা মাঠের আশেপাশে আজ তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কিছু না হলেও হাজার চারেক লোক তো জড়ো হয়েইছে। একপাশে বাঁশটাঁশ খাটিয়ে প্রকাণ্ড ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। একদিকে কাঠের গ্যালারি। মাঠের বাকি দু’পাশ ঘেরা মোটা দড়ি দিয়ে। চা-চানাচুর-মুড়ি মুড়কির বিক্কিরি আজ তুঙ্গে।

পাওভাজির গন্ধে জিভে জল আসছে৷ টেরিবাগানো সরু গোঁফ ছেলেছোকরার দল প্যাভিলিয়নের সামনে হেলানো কেদারায় বেয়ারা, সুদৃশ্য ছাতি, লেমোনেড গেলাস, চীনেমাটির পেয়ালা ফেয়ালা সাজিয়ে চাদ্দিক আলো করে বসে থাকা ভিক্টোরিয়ান হ্যাট মেমসাহেবদের পানে উঁকিঝুঁকি মারছে।

এই ভিড়ে গাঁটকাটাদের উপদ্রব আছে; আবার হতভাগা স্বদেশিগুলো ফস্ করে কখন বোমা টোমা ছুঁড়ে দেবে সে ভয়ও আছে। তাই সমানে চলছে ঘোড়াপুলিশের সতর্ক টহলদারি। বাপেদের কাঁধে পা ঝুলিয়ে ছোটো ছেলেরা ভুরু কুঁচকে, কপালে হাত দিয়ে রোদ্দুর আড়াল করে বল গুনছে।

ঘোড়ার গু মাড়িয়ে, হোঁচট খেঁয়ে, কনুই দিয়ে গুঁতিয়ে, ছাতা দিয়ে খুঁচিয়ে কোনোক্রমে সামনে একচিলতে ফাঁক পাওয়া গেল। এবার দেখা যাক। এত হল্লা কিসের? এই নেটিভগুলোও পারে বটে! কথা নেই বার্তা নেই খামোকা হল্লা করতে লেগেছে। এক মাড়োয়ারির বগলের ফাঁক দিয়ে, এক সর্দারজির গালপাট্টার জঙ্গল সরিয়ে যা দেখা গেল তাতে তো আক্কেল গুড়ুম।

তৎকালীন বোম্বের খ্যাতনামা জিমখানা মাঠ।

হওয়ারই কথা, হবে নাই বা কেন?

বিলেতের মেরিলেবোন ক্রিকেট কেলাব এসেছে কি না বোম্বাইয়ের জিমখানা মাঠে! অ্যাঁ! বিশ্বের সেরা ক্রিকেট ক্লাব এম.সি.সি! খোদ পঞ্চম জর্জ যার পৃষ্ঠপোষক? জোরদার খেলা চলছে। প্রথম ইনিংসে সাহেবরা সাড়ে তিনশোর ওপর রান করেছে আর এদিকে খেলা শুরু হতে না হতেই ‘হিন্দু’রা দু’তিনটে উইকেট হারিয়ে বসে আছে।

প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা যাক যে ক্রিকেট তখন ইংরেজরাই খেলত, বল টল ভারতীয় চাকর বাকররা কুড়িয়ে এনে দিতো। তবে দেশীয় রাজা, জমিনদার আর বোম্বেরে বিশেষত পার্সি ব্যবসায়ীরা আংরেজদের সাথে গা ঘষাঘষি করবে বলেই ক্রিকেটটা শুরু করে। বোম্বেতে তখন চারটে প্রধাণ দল ছিল, সবই জাত বা ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত – হিন্দু, মুসলিম, পারসি ও ইউরোপীয়।

তো যাই হোক, সাহেবদের সাথে জেতার আশা খুব একটা ছিল না বললেই চলে তাও লোকজন তামাশা দেখতে তো হামেশা জুটেই যায়। তবে চার নম্বর ব্যাটসম্যানটা নাকি নেমে খেলার গতিই পালটে দিয়েছে। হতভাগা নাকি ব্যাট করতে নেমেই বাঁহাতি স্পিনার স্টুয়ার্ট বয়েসকে প্যাভিলিয়নের চালে মেরেছে। জিমখানার ওপর দিয়ে ইংরেজ পেসার টেটকে বাইরের রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ির ওপর ফেলেছে – সে ঘোড়া টোড়া ভয় পেয়ে ছুটোছুটি করে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।

খবর ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি। এক মিডিয়াম পেসারকে উইকেট থেকে সরে কভারের ওপর দিয়ে লফট করা বাউন্ডারি দেখে নাকি স্বয়ং আম্পায়ার সাহেবও হাততালি দিয়েছেন। এসব খবর চাউর হতে বেশী সময় লাগে না। বোম্বে জুড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল খবর। লাঞ্চের আগেই হিন্দু দলের ১৫৪ রানে ৬ উইকেট পড়ে গেছে তাও মাঠের চারপাশের দৃশ্য দেখে অবাক হতে হয়। লোকে লোকারণ্য – উঁচু গাছগুলোর দর্শকে বোঝাই। ইংরেজরা প্যাঁদানি খাচ্ছে – এ জিনিস ছাড়া যায়?

লাঞ্চের পর তালঢ্যাঙা, রোগা ছিপছিপে লোকটা হাঁটতে হাঁটতে ক্রিজে এলেন – চলাফেরায় আত্মবিশ্বাস স্পষ্ট৷ পিচের দু’চার জায়গায় ব্যাটটা ঠুকে বুঝে টুঝে নিয়ে স্টান্স নিলেন। তারপরেই শুরু হলো কার্নেজ। ইংলিশ পেসারদের নিয়ে স্রেফ ছেলেখেলা করতে লাগলেন। অ্যাস্টিলের বলে এক ওভারে কুড়ি না বাইশ মারেন তিনি। স্পিনার বেচারাগুলোও ছাড় পায়নি।

মাত্র একশো দশ মিনিট ব্যাট করে ১৫৩ রানে শেষ হয় তাণ্ডব। ১৩টা না চোদ্দোটা বাউন্ডারি আর ১১টা ওভার বাউন্ডারি দিয়ে সাজানো ইনিংস এখনকার টি-টোয়েন্টি তারকাদের কাছেও বেশ ঈর্ষণীয়। ১৯২৬ সালের অক্টোবর মাসের প্রায় বিস্মৃত এই ইনিংস প্রচুর ভারতীয় কিশোর ও তরুণদের ব্যাট তুলে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলো।

ভদ্রলোক যখন প্যাভিলিয়নে ফেরেন তখন নাকি গণ্যমান্য সাহেবসুবোরাও উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছিলো। তিনি আর কেউ নন – ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার কোত্তারি কানাকাইয়া নাইডু ওরফে সি.কে. নাইডু, ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক সি.কে. নাইডু।

১৯৩২ সালে সিংহের গুহা লর্ডসে প্রথম টেস্টে ব্রিটিশ সিংহের মুখোমুখি হয় ভারতীয় দল। প্রথমে অধিনায়ক হিসেবে ‘নির্বাচিত’ পাতিয়ালার মহারাজা ব্যক্তিগত কারণে সফর বাতিল করেন। সহ-অধিনায়ক লিম্বডির যুবরাজ অনুশীলন ম্যাচে আহত হলে সি.কে. নাইডুকে ভারতীয় টেস্ট টিমের নেতৃত্বের ভার দেওয়া হয়।

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সাড়ে তিনশোরও বেশি ম্যাচ খেলা সি.কে. নাইডু বাষট্টি বছর বয়স পর্যন্ত খেলা চালিয়ে যান। ১৯৬৭ সালের ১৪ নভেম্বর মধ্যপ্রদেশে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার।

ওহ্ হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। এমসিসির সাথে বোম্বে জিমখানা মাঠে ঝোড়ো ব্যাটিংয়ের দিন হাজার হাজার দর্শকের ভিড়ে একটা বছর পনেরোর ছেলেও ছিলো। সি.কে.র ব্যাটিং দেখে ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফেরে ছেলেটা এবং তিন-চার বছরের মধ্যেই ইন্ডিয়ার টেস্ট টিমে সুযোগ পায়।

এখনও পর্যন্ত ভারতের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তার ব্যাটিং গড় কেউ ভাঙতে পারেনি আর বিশ্ব ক্রিকেটের নিরিখে তার গড় ঠিক ব্র‍্যাডম্যানের পরেই – ৭১.৬৪; হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, সেদিনের জিমখানা গ্রাউন্ডের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকেই পরবর্তীকালে সারা দেশ একডাকে চিনবে – হি ইজ নন আদার দ্যান দ্য লেজেন্ডারি বিজয় মার্চেন্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link