দ্য ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল’

বিখ্যাত ‘হায়দ্রাবাদি ঘরানার’ প্রকৃত উত্তরসূরী হিসেবে নিজেকে সেই উচ্চতায় নিয়ে গেছেন নিজের দক্ষতা ও নৈপুণ্যে। অ্যাডাম ল‍্যাম্বার্ট যদি তাঁর কণ্ঠস্বর কিংবা জুলিয়া রবার্টস যদি নিজের হাসিকে ইনসুরেন্সের আওতায় রাখতে পারেন তবে, ভিভিএস লক্ষ্মণের জাদুকরি কবজিকেও ইনসুরেন্সের আওতায় আনা হোক।

টেস্ট ক্রিকেট অন্যান্য ফরম্যাটের ক্রিকেটের মতো সহজ নয়। এখানে ভুল সময়ে একটা ভুল সিদ্ধান্ত আপনার হাত থেকে ম্যাচ বের হয়ে যাবে। ব্যাটসম্যানদের এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাটিং করে যেতে হয়, পার্টনারশিপ গড়তে হয়। এখানে টেকটিকে সামান্যতম দুর্বলতাও গ্রহনযোগ্য নয়। একটি ভুল শট ব্যাটসম্যানের সুন্দরভাবে শুরু করা ইনিংসের ইতি টেনে দিতে পারে। বোলারদের ওভারের পর ওভার ব্যাটসম্যানের মতিগতি বুঝে বল করে যেতে হয়।

আসল কথা হলো টেস্ট ক্রিকেটে যেরকম পেশাদারিত্ব, ধৈর্য্য আর দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়, আর কোনো ফরম্যাটেই সেভাবে দিতে হয় না। তাই টেস্ট ক্রিকেট এখনও ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত ফরম্যাট হিসেবে স্বীকৃত। আর সেখানে কোনো ক্রিকেটার বারবার নিজের পেশাদারিত্ব, ধৈর্য্য এবং দক্ষতার পরিচয় বারবার দেন, কিন্তু আধুনিক প্রজন্মের ক্রিকেটার হয়েও সীমিত ওভারের পর্যাপ্ত ক্রিকেট খেলতে না দেওয়াও হয় তাতেও আপনি ক্রিকেটের একজন কিংবদন্তি, দৃষ্টান্ত এবং দূত হয়েই থাকবেন। আর সেই জন‍্যই আপনি যদি ভাঙ্গিপুরাপ্পু ভেঙ্কটসাই লক্ষ্মণ হন তাহলে তো কথাই নেই।

ক্রিকেট পরিসংখ্যানের মোটা খাতাটি টেনে নিয়ে যদি বসেন,তবে তাকে আপনার খুব একটা কেউকেটা গোছের কেউ মনে হবে না। গড়, রানসংখ্যা, সেঞ্চুরি তার ওপরেও আকর্ষণীয়তায় তাঁর চেয়ে এগিয়ে আছেন আরো বহু শতজন। ওয়ানডে গড় মাত্র ৩০.৭৬ আর টেস্ট গড় ৪৫.৯৭। পরিসংখ্যান তো তার সাদামাটাই, তাইতো? রেকর্ডের পাতায় ভূরি ভূরি ক্রিকেটার আছেন, যারা এক তুড়িতেই এইসব রেকর্ডকে পেছনে ফেলতে পারে এবং ভবিষ্যতেও পারবে।

কিন্তু এমন একজন যিনি – হাঁটতে পারছেন না সেই অবস্থাতেও চতুর্থ ইনিংসে টেলএন্ডারদের নিয়ে মোহালিতে অসম্ভব লড়াই করে জয় এনে দিয়েছেন। নেপিয়ারে কঠিন বাউন্সি পিচে আরেক অদম্য,অসাধারণ বাঁহাতি ওপেনারকে নিয়ে ঘন্টার পর মাঠে কাটিয়ে শতরান করে দলকে নিশ্চিত হারের মুখ থেকে টেনে তুলেছেন।

পাকিস্তানের মাটিতে শোয়েব আখতারকে সামলে ভারতের খারাপ অবস্থা থেকে শতরান করে ওয়ানডেতে ঐতিহাসিক সিরিজ জেতানোই হোক – কিংবা শতাব্দীর শুরুতে ভারতীয় ক্রিকেটের টালমাটাল অবস্থার পর অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়াকে আটকাতে আমাদের বিখ্যাত ইডেনে আরেক কিংবদন্তী, বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে জীবনের বাজি নিয়ে ভারতকে জয় এবং সিরিজ এনে দিয়ে স্টিভ ওয়ার  দলের অহংকারকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে যেভাবে ভারতীয় ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তার জন্য তাঁকে কুর্ণিশ।

সাধে কি আর বহু যুগ আগে এক ক্রিকেট লিখিয়ে লিখে গিয়েছিলেন – ‘স্কোরবোর্ড হলো গাধা’। আর জন‍্যই তো হয়ে উঠেছিলেন ভিভিএস লক্ষ্মণ থেকে দ্য ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল’ লক্ষ্মণ যার অবদান ও মাহাত্ম্য শুধু ভারতীয় ক্রিকেট নয় গোটা বিশ্বক্রিকেটে রয়ে যাবেন সর্বদা।

না, তিনি হয়তো তার সমসাময়িকদের  প্রতিভাবান ছিলেন না। অনেকের মতেই, সীমিত ওভারে ছিলেন অচল। বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাননি একবার। কিন্তু, সাদা পোশাকে যখন নামতেন – তখনই নিজের জাতটা চিনিয়ে দিতেন।

তার ছিল অসাধারণ ধৈর্য্য এবং হাল না ছাড়ার মানসিকতা। দলের প্রয়োজনে নানা জায়গায় ব‍্যাট করেছেন কিন্তু সব স্থানেই নিজেকে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন বারবার। চোখের নিচে কবজির মোচড়ে যখন একজন অসাধারণ শিল্পীর মতো সূক্ষ তুলির আঁচড়ের মতো বলগুলোকে বিপক্ষের ফিল্ডারদের থেকে দূরে নিয়ে যেতো এক অসাধারণ মোহময়তা ছড়িয়ে যেতো।

খেলাতে সবসময় বিশুদ্ধতার প্রয়োগ করতে চাইলেও দুঃসাহসিক হয়ে উঠবার ক্ষমতাও তাঁর ছিল। দলের কঠিন সময়ে বারবার প্রমাণ করায় বলে যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও অসাধারনত্বের মাত্রা। অন‍্যদের সঙ্গে যখন ব‍্যাট করতেন তখন উল্টোদিকে যেমন ‘রক কর্নশাট’ চলছে মনে হতো আর তার দিকে মনে হতো এক সুন্দর মোহময়ী সুর ভেসে আসছে, যার সৌরভে ভক্ত-সমর্থকরা মোহিত হয়ে যেত সর্বদা।

বিখ্যাত ‘হায়দ্রাবাদি ঘরানার’ প্রকৃত উত্তরসূরী হিসেবে নিজেকে সেই উচ্চতায় নিয়ে গেছেন নিজের দক্ষতা ও নৈপুণ্যে। অ্যাডাম ল‍্যাম্বার্ট যদি তাঁর কণ্ঠস্বর কিংবা জুলিয়া রবার্টস যদি নিজের হাসিকে ইনসুরেন্সের আওতায় রাখতে পারেন তবে, ভিভিএস লক্ষ্মণের জাদুকরি কবজিকেও ইনসুরেন্সের আওতায় আনা হোক।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...