বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট যে অবস্থানে আছে তাঁর পেছনে আছে অনেক ইতিহাস। কিছু কান্না কিছু আনন্দ মিলিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট। এখন বাংলাদেশ সেরা অবস্থানে রয়েছে, যার নেতৃত্বে সাকিব, তামিম, মুশফিকের মত একঝাক পরীক্ষিত তারকা এবং তাদের যোগ্য সঙ্গী কিছু তরুণ তুর্কী।
কিন্তু আমাদের ক্রিকেট এ পর্যায়ে পৌছানো অতটা সহজ ছিলনা, আর সেই কঠিন সময়ে যখন আমরা ক্রিকেটের প্রথম পর্যায়গুলো পার করছিলাম, তখন আমাদের ব্যাটিং এর মূল ভরসা ছিলেন হাবিবুল বাশার। শুধু ব্যাটিং নয় তার অসাধারণ নেতৃত্বও আমাদের ক্রিকেটের এই পর্যায়ে পৌঁছাতে ভূমিকা পালন করেছে।
হাবিবুল বাশারের জন্ম ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট কুষ্টিয়া জেলার নাযাকান্দা গ্রামে। তার পুরো নাম কাজী হাবিবুল বাশার। তিনি ছিলেন একজন ডান-হাতি ব্যাটসম্যান। টুকটাক বল হাতেও দেখা গেছে, তার বোলিংয়ের ধরণ ছিল অফ ব্রেক।
বাশার প্রথমে নজরে আসেন ১৯৮৯ সালের যুব এশিয়া কাপে, এ টুর্নামেন্টে তার সাথে খেলেছিল সৌরভ গাঙ্গুলি, অজয় জাদেজা, মঈন খান, মারভান আতাপাত্তুর মত গ্রেট প্লেয়াররা। ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরের ভারত সফরে বাশার একটি প্রস্তুতি ম্যাচে অংশ নিয়েছিলেন।
অবশেষে ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে, শারজায় শ্রীলংকা বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক হয় বাশারের। অভিষেক ম্যাচে বাশার ৩নং পজিশনে ব্যাটিং এ নেমে ৩৫ বলে ১৬ রান করেন। বাংলাদেশ এ ম্যাচে ১০৭ রানের বিশাল ব্যবধানে হেরে যায়।
পরবর্তী ম্যাচেই মুখোমুখি হন পাকিস্তানি কিংবদন্তী পেসার ওয়াসিম আকরামের, কিন্তু বলার মত কিছু করতে পারলেন না বাশার। ক্যারিয়ারের প্রথম ডাক মেরে প্যাভিলিয়নে ফিরেন তিনি।
তখন বাংলাদেশ ওয়ানডে খেলতো কালেভদ্রে। তাই পরবর্তী ওয়ানডে ম্যাচের জন্য বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয় ২ বছর। তখনকার সময়ে বাংলাদেশ নিয়মিত ওয়ানডে কিংবা ওয়ানডে সিরিজ খেলার সুযোগ পেত না, কারণ বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস না থাকা।
১৯৯৭ এর এশিয়া কাপে পাকিস্তানের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। দীর্ঘদিন পর খেলতে নেমে আবারো শূণ্য রানে আউট হন তিনি। তবে জায়গা পেয়ে যান নামিবিয়ায় আয়োজিত কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজে। সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানো শুরু ‘মিস্টার ফিফটি’র।
এ সিরিজে বাশারের প্রথম ম্যাচ ছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, শক্তিশালী জিম্বাবুয়ে বাংলাদেশকে ৩০৬ রানের বিশাল টার্গেট ছুড়ে দেয়। বাংলাদেশ হেরে গেলেও হাবিবুল বাশার ৭০রান করে নিজের জাত চেনান।
কিন্তু নিয়মিতভাবে রান না পাবার ফল পেতে হলো বেশ ভালোভাবেই। জায়গা হলো না ১৯৯৯ বিশ্বকাপের দলে, যা আজও বাংলাদেশ ক্রিকেটে আলোচিত ঘটনার মধ্যে একটি ধরা হয়।
বিশ্বকাপের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে আবারো ডাক পান। তবে খেলা হয়নি ম্যাচ। তবে হাবিবুল বাশার নিজের সেরা ইনিংসটি খেলেন ইংল্যান্ড এ দলের বিপক্ষে, ১৪৩ রানের অসাধারণ ইনিংসটি খেলেছিলেন বিখ্যাত ইংলিশ পেস আক্রমণ সামলে।
তার এ ফর্ম ঘরোয়া ক্রিকেটেও অব্যাহত থাকে, মোহামেডানের বিপক্ষে তিনি ৭০ রান করেন। বাশার আবারো জাতীয় দলে ফিরেন ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে।
ভারতের বিপক্ষে তিনি ৫৭ রানের ঝলমলে একটি ইনিংস খেলেছিলেন। তখনি আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস লাভ করে ২০০০ সালে।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অভিষেক টেস্টে জায়গা হয় তরুণ হাবিবুল বাশারের। দারুণ খেলছিলেন টেস্ট অভিষেক ইনিংসে, কিন্তু তাঁর ৭০ রান চাপা পড়ে যায় আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সেঞ্চুরিতে। ইনিংসটিতে বাশারের ফুট ওয়ার্ক, পুল এবং টাইমিং সমালোচক দের প্রশংসা কুড়ায়। কিন্তু পুরো ক্যারিয়ারে বাশারের পুল এবং হুক করার প্রবণতা অনেক বেশী ছিল। যদিও তিনি এ শটেই সফলতা পেয়েছিলেন তারপরও এ পুলই তার অনেক চমৎকার শুরুকে ফুটে উঠতে দেয়নি।
দিনে দিনে টেস্টে বাংলাদেশ নাজেহাল হতে থাকে। কিন্তু বাশার ব্যাট হাতে একাই লড়াই করে যাচ্ছিলেন। বাংলাদেশ ম্যাচ হারলেও তিনি তার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এমনই এক ম্যাচে ২০০১ সালে চট্রগ্রামে জিম্বাবুয়ে বিপক্ষে ৫৪২ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে বাশারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির পরও ফলোঅন এড়াতে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। ফলোঅনে পড়েও দ্বিতীয় ইনিংসেও বাশার ৭৬ রানের ইনিংস খেলেন।
তারপর নিউজিল্যান্ড সফরে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে তিনি ৬১ রান করেন। তখনও টেস্ট জয় ছিল অধরা, বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে সমালোচিত হচ্ছিল বাজে পারফরম্যান্সের জন্য। তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়, নতুন কোচ আসেন বিশ্বকাপজয়ী ডেভ হোয়াইটমোর। নতুন অধিনায়ক হন খালেদ মাহমুদ সুজন।
২০০৩ সালের পাকিস্তান সফর, আমাদের চির আফসোসের মুলতান টেস্ট ছিল সেই সফরেই। বাংলাদেশ প্রথমবারের মত টেস্টে নিজেদের সামর্থ্য কিছুটা হলেও প্রমাণ করে।
হাবিবুল বাশার হয়ে উঠেন মিডল অর্ডার এর কাণ্ডারি। সে সিরিজে ৬৩ গড়ে ৩৬৩ রান করে সিরিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন। সিরিজে তিনি ৩ টি ফিফটি ও একটি সেঞ্চুরি করেন।
সুজনের অধিনায়কত্ব খুব একটা ইম্প্রেসিভ না হওয়ায় ২০০৪ সালের জিম্বাবুয়ে সিরিজে সেই দায়িত্ব পান হাবিবুল বাশার। সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ পরিত্যক্ত হবার পর তৃতীয় ম্যাচে জিম্বাবুয়েকে ৮ রানে হারিয়ে জয়খরা কাটায় বাশারের বাংলাদেশ।
তারপর বাংলাদেশ ঐ সিরিজে একটি টেস্ট ম্যাচও ড্র করতে সমর্থ হয়, যা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য অনেক বড় একটি অর্জন ছিল। বাশারের অধিনায়কত্ব বাংলাদেশ ক্রিকেট আলোর সঞ্চার করছিল। ২০০৪ সালের ক্যারিবিয়ান সফর ছিল বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে আরেক মাইলফলক।
সিরিজের প্রথম টেস্টে বাশারের দুর্দান্ত ১৩১ বলে ১১৩ রানের উপর ভর করে বাংলাদেশ ৪১৬ রান করে, যদিও মোহাম্মদ রফিক ইনিংসের শেষের দিকে সেঞ্চুরি করেছিলেন। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩৫৩ রানে অলআউট হলে লিড পায় বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের সেই বিখ্যাত ব্যাটিং কল্যাপস ঘটে, শেষ পর্যন্ত খালেদ মাসুদ পাইলটের সেঞ্চুরির কল্যানে টেস্ট ড্র করতে সমর্থ হল বাংলাদেশ।
এটা পরিষ্কার ছিল যে, হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাংলাদেশ ক্রিকেট সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। বাংলাদেশ ক্রিকেটের আরো একটি অসাধারণ বিজয় আসে ২০০৪ সালের বক্সিং ডে তে ভারতের বিপক্ষে। এ ম্যাচে বাশার তেমন রান না পেলেও মাশরাফি ম্যাজিকে ভারতবধ করে বাংলাদেশ।
তখনো আসেনি টেস্ট জয়। অবশেষে তাও আসলো। ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ে বাংলাদেশে আসে ২ টেস্ট ও ৫ ওয়ানডে খেলতে।
প্রথম টেস্টে চট্রগ্রামে বাংলাদেশ দুর্দান্ত ব্যাটিং, বোলিংয়ে নিজদের টেস্ট ইতিহাসের প্রথম জয় তুলে নিতে সক্ষম হয়। দুই ইনিংসে ৯৪ ও ৫৫ রান করে বাশার এ বিজয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। দ্বিতীয় টেস্ট ড্র করে বাংলাদেশ টেস্ট সিরিজে জয়লাভ করে। বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে টেস্ট সিরিজ হাতে নেন হাবিবুল বাশার।
ওয়ানডে সিরিজে ২-০ তে পিছিয়ে পড়েও বাংলাদেশ ৩-২ ব্যাবধানে সিরিজ জিতে যায়, যেখানে বাশার নিয়মিত রান করেছিলেন। নতুন স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ ২০০৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ড সফর করে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ কাটে দুঃস্বপ্নের মত।
তারপরই ত্রিদেশীয় সিরিজে বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দেয়। মোহাম্মদ আশরাফুলের মহাকাব্যিক সেঞ্চুরির পাশাপাশি বাশারের অধিনায়কোচিত ৪৭ রান এ ম্যাচ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরের বছর বাংলাদেশ সফরের ফতুল্লা টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে নাড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। শাহরিয়ার নাফিসের ১৩৮ ও বাশারের ৭৬ রানের ফলে প্রথম ইনিংসে ৪২৭ রানের বড় সংগ্রহ পায় বাংলাদেশ। অ্যাডাম গিলক্রিস্টের ম্যাচ বাচানো ১৪৪ রানের পরও ২৬৯ রানে অলআউট হয় অস্ট্রেলিয়া। টেস্ট জয়ের এমন অসাধারণ সুযোগের সামনে দাড়িয়েও বাংলাদেশ তাদের বিখ্যাত ২য় ইনিংস ব্যাটিং কলাপ্স এড়াতে পারেনি, ফলে ১৪৮ রানে অলআউট হয়ে অস্ট্রেলিয়াকে ৩০৭ রানের লক্ষ্য ছুড়ে দেয়। রিকি পন্টিং এর অধিনায়কোচিত সেঞ্চুরিতে অস্ট্রেলিয়া ৩ উইকেটে জয়লাভ করে।
তারপর বাংলাদেশ ২০০৭ বিশ্বকাপ লক্ষ্য করে নবীন প্রবীণ কম্বিনেশন গঠনের জন্য সাকিব, তামিম, মুশফিকের মত তরুণদের দলভুক্ত করে। বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল ভারত, শ্রীলংকা ও বারমুডা। তারপরও বাংলাদেশ সাফল্য পেতে আত্মবিশ্বাসী ছিল।
তারপর যা ঘটেছিল তা সত্যিই বিস্ময়কর ছিল। গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশ ভারতকে হারিয়ে তাক লাগিয়ে দেয়। তারপর বারমুডাকে হারিয়ে সুপার সিক্সে জায়গা করে নেয়। সুপার সিক্সে আরেক পরাশক্তি দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। অসাধারণ নেতৃত্ব দিলেও ব্যাটিং এ একদমই রান না পাবার ফলে অনেকেই বাশারের ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিল।
বিশ্বকাপের পরে দ্রুতই ভারত বাংলাদেশ সফরে আসে। টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজে বাশারের বাজে ফর্ম চলতে থাকে যার ফলে এ সিরিজেই তার ওয়ানডে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়, তখনও তিনি টেস্ট খেলা চালিয়ে যান। ২০০৮ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে তার টেস্ট ক্যারিয়ারেরও সমাপ্তি ঘটে।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তির পর বাশার আইসিএলে যোগ দেন এবং আইসিএল বাংলাদেশ একাদশের নেতৃত্ব দেন তিনি। তারপর দেশে ফিরে ২০১০ সালে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে ফিরেন এবং নিজের শেষ ম্যাচে শতরান করেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের নির্বাচকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য।
যদিও বাশার এমন এক সময়ে বাংলাদেশে হয়ে খেলেছিলেন যখন বাংলাদেশ পায়ের নিচের মাটি খুঁজে পাচ্ছিল না, তারপরও বাংলাদেশ ক্রিকেটে তার অবদান ছিল অতুলনীয়। তরুণদের এগিয়ে আসা এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছানোতে তার অবদান ছিল অবিস্মরণীয়।
তিনি ৫০ টেস্টে ৩১ গড়ে ৩০২৬ রান করেন। ৩ শতক এবং ২৪ টি অর্ধশতকও করেন। ১১১ ওয়ানডেতে ২২ গড়ে ১৪ টি হাফ সেঞ্চুরিসহ ২১৬৮ রান করেন। শুধুমাত্র রান দিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটে বাশারের অবদান বুঝানো যাবে না, তিনি ছিলেন আমাদের ক্রিকেটের অন্যতম মহানায়ক। বাংলাদেশ ক্রিকেট যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন ভক্তকুলের মাঝে বেঁচে থাকবেন হাবিবুল বাশার সুমন।