স্বপ্নের দুয়ার খোলার সেই জয়

ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলটা এখন বেশ শক্তিশালী। বাকি দুই ফরম্যাটের তুলনায় ওয়ানডেতে বেশ ভাল দল বাংলাদেশ। দেশের মাটিতে নিয়মিতই জয়ের দেখা মিলছে, বিদেশের মাটিতেও শক্তিশালী প্রতিপক্ষদের হারিয়ে দিচ্ছেন সাকিব-তামিমরা। ওয়ানডেতে বিশ্বসেরা দলগুলোর চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে জানে বাংলাদেশ। কিন্তু এই দলটাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আগমনের পর ছিল পরাজয়ের বৃত্তে। রঙিন পোশাকে একের পর এক ম্যাচ হেরেই চলছিল বাংলাদেশ দল। প্রথম বাইশ ওয়ানডেতে ছিল না কোনো জয়ের দেখা। একটা জয় খুঁজে পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১২ বছর আর ২২ ম্যাচ!

বাংলাদেশ ক্রিকেটে সেরা বাঁ-হাতি স্পিনারদের তালিকা করলে সবার উপরের দিকে সাকিব-রাজ্জাকদের পাশে থাকবেন মোহাম্মদ রফিক। ব্যাটিংটাও করতেন দুর্দান্ত। ব্যাট হাতে ঝড় তুলতে পারতেন তিনি। যেসময় বাংলাদেশ দলটা নিয়মিতই প্রতিপক্ষের কাছে পরাস্থ হত – সেসময় দলের অন্যতম সেরা পারফরমার ছিলেন এই রফিক। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য তিনি সর্বকালের সেরা মহানয়কই। এই রফিকের হাত ধরেই যে এসেছিল বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়। বারো বছর ধরে স্বপ্ন দেখা সেই অধরা জয়ের নায়ক ছিলেন এই স্পিন জাদুকর।

হায়দ্রাবাদের লাল বাহাদুর শাস্ত্রী স্টেডিয়ামে সেদিন কেনিয়ার বিপক্ষে মাঠে নামে বাংলাদেশ। ১৯৮৬ সালে আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে পথচলা শুরুর পর ২২ ম্যাচে জয়ের দেখা নেই। শক্তিশালী কেনিয়ার বিপক্ষে জয় পাবে এমনটাও কারো ভাবনায় ছিল না। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে মোহাম্মদ রফিকের দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচ জয় করে বাংলাদেশ।

১৯৮৬ সালের এশিয়া কাপে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ বাংলাদেশের। তবে প্রতিপক্ষের সামনে দাঁড়াতেই পারছিলন না বাংলাদেশ দলটা। প্রথম ২২ ম্যাচেই পরাজয়। যেন মাঠে নামছেই পরাজয়ের বোঝা বাড়াতে। তবে এরপর এল ইতিহাস গড়ার দিন। বাংলাদেশ ক্রিকেটে এক নতুন ইতিহাসের শুরুর দিন।

সাল ১৯৯৮। ভারতে আয়োজিত ত্রিদেশীয় সিরিজে অংশ নেয় বাংলাদেশ ও কেনিয়া। প্রথম দুই ম্যাচে ভারতের কাছে শোচনীয় হার নিয়ে মাঠ ছাড়ে আকরাম-রফিকরা। নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে কেনিয়ার বিপক্ষে মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। এক বছর আগেই এই কেনিয়াকে হারিয়ে আইসিসি ট্রফি শিরোপা জিতেছিল আকরামরা।

দিবা-রাত্রির ম্যাচে টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে রফিক-সুজনদের বোলিং নৈপুণ্য এক ওভার বাকি থাকতে ২৩৬ রানে গুড়িয়ে যায় কেনিয়ার ইনিংস। রবি শাহের পঞ্চাশ আর হিতেশ মোদির চল্লিশ রান ছাড়া কেউই সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি। রফিকের তিন উইকেট ছাড়া খালেদ মাহমুদ সুজন, এনামুল হক মনিরা শিকার করেন ২টি করে উইকেট। তবে বাঁ-হাতি পেসার মোর্শেদ আলি খানের কিপটে বোলিংয়ে যেন চাপে পড়ে কেনিয়া। ৭ ওভারে মাত্র ২৬ রানের বিনিময়ে ১ উইকেট নেন এই পেসার।

বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্যমাত্রা ২৩৭। আগের দুই ম্যাচের একটিতেও দুইশোর কোটা ছুঁতে পারেনি আকরাম-নান্নুরা। এই বিশাল লক্ষ্যমাত্রার সামনে বাংলাদেশের ব্যাটিং শিবির মুখ থুবড়ে পড়বে এমনটাই অনুমেয় ছিল। তবে ফ্লাড লাইটের আলোয় সেদিন দেখা মিলেছিল ভিন্ন এক বাংলাদেশের। পেছনের মাস্টারমাইন্ড বলতে পারেন কোচ গর্ডন গ্রিনিজকে। আতাহার আলী খানের সাথে ওপেনিংয়ে পাঠিয়ে দিলেন মোহাম্মদ রফিককে।

লোয়ার অর্ডারে ব্যাট করা রফিক সেদিন ওপেন করবেন। আসলে, মোহাম্মদ রফিক তখন পিঞ্চ হিটার হিসেবে প্রায়ই ওপেনার হিসেবে নামতেন। এবারও তাই হল। পরিকল্পনা স্পষ্ট; রফিক দ্রুত রান করতে পারলে একটা আশা জাগবে। অসহায় আত্মসমর্পণের চেয়ে জয়ের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা আর কি। কোচের আস্থা, ভরসার সবটার পূর্ণ প্রতিদান সেদিন দিয়েছিলেন রফিক। আতাহার আলীর সাথে ব্যাট করতে নেমে ওপেনিংয়ে ব্যাট হাতে তুলেছিলেন ঝড়।

একদিকে উইকেটে মাটি কামড়ে পড়েছিলেন আতাহার; সিঙ্গেল নিয়ে রফিককে স্ট্রাইক দিচ্ছিলেন। আরেকপ্রান্তে দ্রুত রান তোলায় মত্ত ছিলেন রফিক। ৮৭ বলে ৮ চার ও ১ ছক্কায় খেললেন ৭৭ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। রফিক ঝড়ে ওপেনিং জুটিতেই আসে ২৬ ওভারে ১৩৭ রান। কোচের পরিকল্পনা সফল; প্রথম ওয়ানডে জয়ের হাতছানি বাংলাদেশের সামনে। তবে তীরে এসে এর আগেও বেশ কয়েকবার তরি ডুবেছে। তাই তখনো ভয়টা ছিল।

রফিকের ৭৭ রান আর আতাহার আলীর ৪৭ রানের পর বাংলাদেশের সামনের জয়ের পথটা বেশ সহজ হয়ে যায়। মিনহাজুল আবেদিন নান্নু দ্রুত ফিরলেও আমিনুল ইসলাম বুলবুল আর আকরাম খানের ব্যাটে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। চতুর্থ উইকেটে দু’জনে মিলে যোগ করেন ৬২ রান। ব্যক্তিগত ৩৯ রানে আকরাম যখন আউট হন দলের প্রয়োজন তখন ১৯ বলে মাত্র ৯ রানের। নাইমুর রহমান দূর্জয়ের ৪ ও বুলবুলের অপরাজিত ২০ রানে ৬ উইকেট হাতে রেখেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। স্টিভ টিকোলো, মার্টিন সুজিরা সেদিন দমাতে পারেনি রফিক-আকরামের।

ড্রেসিং রুমে খালেদ মাসুদ পাইলট, হাসিবুল শান্তদের বাঁধভাঙ্গা উল্লাস। বাংলাদেশি সমর্থকদের জন্য ঐতিহাসিক এক দিন। তৎকালীন বাংলাদেশের কোচ ক্যারিবীয় তারকা গর্ডন গ্রিনিজের এক সিদ্ধান্ত বদলে দিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের পথ। বাইশ ম্যাচ পরাজয়ের পর বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডে জয়। বাংলাদেশ বাংলাদেশ জয়ধ্বনি উঠছিল চারিদিকে। সেই যে শুরু – সেখান থেকে বাংলাদেশ এখন ওয়ানডে ক্রিকেটে অন্যতম সেরা। আকরাম-রফিকদের দলটা এখন নির্ভয়েই দেশে আর দেশের বাইরে প্রতিপক্ষকে মাত দিচ্ছে অনেকটা নিয়মিতই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link