সে যেন এক মহাকালের পথে যাত্রা। ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্খিত অধ্যায়ের শুরু। যতবার পৃথিবীতে ব্যাটে বলের স্পর্শ হবে ঠিক ততবার আপনাকে সেই ইতিহাসের কাছে ফিরে যেতে হবে। আধুনিক ক্রিকেট আরো যত রঙিনই হোক না কেন, আপনাকে ১৯৯০ সালের একটা সাদাকালো ছবিতে ফিরে যেতে হবে। ক্রিকেট যত দুরন্ত গতিতেই এগিয়ে যাক এই খেলাটাকে শচীন রমেশ টেন্ডুলকারে এসে থামতে হবে। যেমনটা তিনি ব্যাট করতে নামলে থমকে যেত গোটা ভারত।
পরের দিন ভারতের স্বাধীনতা দিবস। ৪৩ বছর আগে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়া ভারত আবারও সেদিন হারতে বসেছিল সেই ইংল্যান্ডের কাছেই। পুরো ভারত যখন পরের দিনের উদযাপন নিয়ে ব্যস্ত তখন ভারতের একটা দল ম্যানচেস্টারে টেস্ট ম্যাচের শেষ দিনে ম্যাচ বাঁচাতে লড়ছে। সেদিন ম্যানচেস্টারে ভারতের নায়ক ছিল ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর।
যিনি পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন ক্রিকেট ইতিহাসেরই সবচেয়ে বড় নায়ক। এখনো ভারতের কোন ছোট্ট শহরে মেলা বসলে যার পোস্টার কিনতে লাইন ধরে ছোট্ট ছোট্ট ছেলেরা। তাঁরাও একদিন শচীন টেন্ডুলকার হবার স্বপ্ন দেখে। মুম্বাইয়ের শিবাজি পার্কের মাঠটায় এখনো প্রতিদিন হাজার হাজার কিশোর ব্যাট হাতে ছুঁটে যায়। তাঁরা ভাবে এইখান থেকেই তো একজন শচীন টেন্ডুলকার তৈরি হয়েছিল।
১৯৯০ সালের ১৪ আগস্টের সেই ইনিংসে ফিরে যাওয়া যাক। অবশ্য আরো একটু পিছনে ফিরে যেতে হয় তাঁর আগে। ১৮৮৮-৮৯ মৌসুমে মুম্বাইয়ের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েছিলেন মাত্র ১৬ বছরের একটা ছেলে। ফলে ওই কিশোরের উপর ভরসা রেখেই ভারত তাঁকে ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক করায়। এরপর একে একে আরো আটটি টেস্ট খেলেন শচীন। তবে তখনো কোন সেঞ্চুরির দেখা পাননি। ৮ টেস্টে সর্ব্যসাকুল্যে তাঁর তখন মাত্র ৩ হাফ সেঞ্চুরি।
তবুও ভারত সেই কিশোরের উপর ভরসা রেখেছিল। সেই ভরসারই প্রতিদান শচীন দিয়েছিলেন ১৯৯০ সালে ১৪ আগস্ট। ভারতের এই আস্থার প্রতিদান শুধু ভারতের ক্রিকেটই নয় বরং গোটা ক্রিকেটবিশ্ব পেয়েছিলে। ক্রিকেট পেয়েছিল তাঁর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় তারকাকে। পরবর্তী দুই যুগে তিনি উইলো হাতে চুরমার করেছিলেন সকল ট্রেডমার্ক।
সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ইংল্যান্ড ভারতের সামনে ৪০৭ রানের বিশাল এক টার্গেট ছুঁড়ে দিয়েছিল। টেস্টের শেষ দিনে ব্যাট করতে নেমে ১০৯ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলে ভারত। পুরো ক্রিকেট বিশ্বই তখন ভাবছিল ভারতের হারটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। তবে ছয় নম্বরে ব্যাট করতে নামা শচীন টেন্ডুলকারের মনে ছিল ভিন্ন ভাবনা। আগের আট টেস্টের ব্যর্থতার গ্লানি তিনি মুছে দিতে চেয়েছিলেন সেদিন। এছাড়া গোটা বিশ্বকেও নিজের আগমনী বার্তার জানান দেয়ার জন্য বেঁছে নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডকেই।
টেস্টের শেষ দিনে ওই কঠিন পিচে মনোজ প্রভাকরের সাথে গড়েন ১৬০ রানের অপরাজিত এক জুটি। এর আগে ১৭ বছর বয়সে তুলে নেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি। সেদিন যারা লিখেছিলেন শচীনের সেঞ্চুরি নিয়ে তাঁরা কি ভেবেছিলেন তাঁদের আরো ৯৯ বার এই কাজটা করতে হবে। ১৮৯ বলে ১১৯ রানের অপরাজিত সেই ইনিংসে ভর করে ম্যাচ বাঁচিয়েছিল ভারত। দিনশেষে ভারতের স্কোর দাঁড়ায় ৩৪৩ রানে ৬ উইকেট।
সেদিন হয়তো খালি চোখে মনে হয়েছিল এই সেঞ্চুরিটা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শুধু একটা ম্যাচ বাঁচিয়ে দিল। তবে সময় জানতো এই সেঞ্চুরি এক বিশাল ইতিহাসের একটা অধ্যায় মাত্র। কিংবা মুম্বাই শহরে তাঁর বাটিং দেখার জন্য বেচা- বিক্রি বন্ধ করে দেয়া দোকানকার হয়তো জানতো এই ছেলে অনেকদূর যাবে। কিংবা শিবাজি পার্কের গুরু রমাকান্ত আচরেকার হয়তো শুধুই মুচকি হেসেছিলেন।
কাকতালীয় ব্যাপার হল, এই সেঞ্চুরির ঠিক ৪২ বছর আগে ঠিক একই দিনেই ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ইনিংস খেলতে নেমেছিলেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। মোটে চারটা রান করতে পারলেই টেস্টের গড় ১০০ রেখে শেষ করতে পারতেন। পারেননি, এরিক হলিসের বিপক্ষে মাত্র দ্বিতীয় ডেলিভারিটা মোকাবেলা করতে গিয়েই বোল্ড হয়ে যান।
লন্ডন ওভালের সেই আক্ষেপ কি ম্যানচেস্টারে ঘুঁচাতে পেরেছিলেন শচীন? পারুন আর নাই পারুন অন্তত ব্যাটিং শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাটনটা কালক্রমে নিজের হাতে নিতে পেরেছিলেন। ১০০ গড় না হোক, ক্যারিয়ার পরে শেষ করেছিলেন ১০০ টি সেঞ্চুরি দিয়ে!