ঘরোয়া ফুটবলের নীরব চলা

একটা দেশের ঘরোয়া ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর জাতীয় লিগ। যেমন ইংল্যান্ডের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, স্পেনের লা লিগা কিংবা ইতালির সিরি-আ।

কোটি কোটি টাকায় ট্রান্সাফার মার্কেট কাপিয়ে বেড়ায় সে-সব লিগের ক্লাব কর্তারা। নামকরা সেরা একজন খেলোয়াড়কে দলে ভেড়াতে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এসকল কিছুই করা হয় দর্শকদের উৎসাহ বাড়াতে। ক্লাবের ফ্যান তৈরি তথা বৃহৎ অর্থে লিগের প্রতি দর্শকদের আকর্ষণ বাড়াতেই ক্লাবকর্তারা কোটি টাকা খরচ করতেও কার্পণ্য করেন না। এর পেছনে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সহায়তা থাকে দেশগুলোর ফুটবল সংস্থার।

বিশ্বব্যাপী মিডিয়া কাভারেজ যেন ইউরোপিয়ান ফুটবলের উন্মদনা বাড়িয়ে দেয় শতগুণ। এত এত মুখরোচক খবর, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, নামি-দামি খেলোয়াড়দের নিয়ে ওঠা গুজব ইউরোপিয়ান ফুটবলের মোহে বেধেছে এই উপমহাদেশের ফুটবভক্তদেরও। তাই হয়তো মধ্যরাতে ফুটবলীয় লড়াই দেখতে বসে যান টিভি সেটের সামনে, পরদিন সকালবেলা অফিসে যাবার তাড়া অথবা পরীক্ষার চিন্তা উপেক্ষা করেও।

হতাশার ব্যাপার হলো, উপমহাদেশের সেই ফুটবল পাগল সমর্থকদের দেশ বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগে নেই তেমন কোন সাড়াশব্দ।

দেশের ফুটবলে নেই মিডিয়া কাভারেজ। একটি মাত্র টিভি চ্যানেল সরাসরি খেলা সম্প্রচার করলেও বাকি টিভি চ্যানেলগুলোতে নেই তেমন কোন খবরাখবর। দায়সারা ভাবে ফুটবলের খবর সম্প্রচার করতে হয় বলেই হয়ত দু’এক মিনিটের মধ্যে দিনের খেলার ফলাফল জানিয়েই ইতি টেনে চলে যান সংবাদপাঠক। পত্রিকাগুলোর খেলার পাতায় হয়ত যায়গা হয় বড় কোন খবর হলে। সোশ্যাল মিডিয়াতে নেই তেমন আলাপ-আলোচনা। ঢাকার মাঠ অনেক দিন ধরেই দর্শকশূন্য।

এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাতীয় দলের সাফল্যের ঘাটতি। র‍্যাংকিং-এ অবনতি। খেলোয়াড়দের মান, খেলার মান নিয়ে সবার মনেই রয়েছে  প্রশ্ন। তাছাড়া ঘরোয়া লিগগুলোতে প্রায়শই ম্যাচ ফিক্সিংয়ের গুঞ্জন  দর্শকদের নিরুৎসাহিত করছে বহুগুণে। এছাড়া মাঠগুলোর অব্যবস্থাপনা, গ্যালারির বেহাল দশা দর্শক মাঠে টানতে ব্যর্থ।

দর্শক মাঠে ফেরাতে প্রয়োজন খেলার মান বাড়ানো, খেলোয়াড়দের মান বাড়ানো। বিদেশি ভাল মানের খেলোয়াড়দের দেশের ঘরোয়া লিগে অংশগ্রহণ খেলোয়াড়দের মান বাড়াতে সহয়তা করবে। শুধুমাত্র আক্রমণ ভাগেই নয়, বিভিন্ন পজিশনের খেলোয়াড়দের দলে অন্তর্ভুক্ত করা, বিদেশিদের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশিয় খেলোয়াড়দের খেলতে পারার সক্ষমতা গড়ে তুলতে পারলেই কেবল খেলার মানে উন্নতি করা সম্ভব। ভারতের আইএসএল এর মতো ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক টুর্নামেন্ট হতে পারে উদাহরণ।

দূর্বল অবকাঠামো দিয়ে খেলার মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বাফুফের প্রয়োজন আগে দেশের মাঠগুলোকে আন্তর্জাতিক মাঠগুলোর আদলে গড়ে তোলা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবহেলায় পরে থাকা মাঠগুলো বাফুফের আওতাধীন করে মাঠগুলোর ড্রেনেজ ব্যবস্থা, গ্যালারি থেকে শুরু করে খেলোয়াড়দের থাকার সু-ব্যবস্থা করা। একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যালেন্ডার তৈরি করা এবং দক্ষতার সাথে সবগুলো টুর্নামেন্ট আয়োজন করা। খেলার মাঠগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি জাতীয় দলের প্রতি মনোযোগী হওয়া। নতুন নতুন টেকনলোজির সহায়তা নিয়ে খেলোয়াড়দের সক্ষমতা বাড়ানো এবং বেশি বেশি বিদেশি দলের সাথে দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করা। এতে করে খেলোয়াড়দের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়বে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য, আকৃষ্ট হবে দর্শক।

তবে এই দর্শক খরা ও জাকজমক হীন পরিস্থির উন্নতির আশায় কাজ করছে বেশ কিছু নবাগত ক্লাব। নতুন ক্লাব বসুন্ধরা কিংস কিংবা সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবের পাশাপাশি পুরোনো ক্লাব আবাহনী, শেখ জামাল আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ফুটবলের হারানো জৌলুশ ফিরিয়ে আনতে। নবাগত হিসেবে বিশ্বকাপে খেলা কোস্টারিয়ান তারকা কলিনদ্রেসকে দলে ভিড়িয়ে তাক লাগিয়েছিল কিংস কর্তারা। বেশ দাপটের সাথে খেলে গেছেন দানিয়াল কলিনদ্রেস। এই মৌসুমে কিংস লোনে নিয়ে এসেছেন ব্রাজিলিয়ান রবসনকে। আর আর্জেটিনার জাতীয় দলে খেলা বার্কোসতো রয়েছেনই গত মৌসুম থেকে। অসাধারণ দু’জন খেলোয়াড় এই মৌসুমে খেলছেনও দারুণ। যার ফলশ্রুতিতে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে রয়েছে বসুন্ধরা কিংস, বাংলাদেশ ক্লাব ফুটবলের জায়েন্ট ঢাকা আবহনীকে পেছনে ফেলে।

আবাহনী, মোহামেডান, শেখ জামালের কর্মকর্তারাও বেশ বুঝে শুনে খেলোয়াড়  ভেড়াচ্ছেন দলে। আফ্রিকান খেলোয়াড়দের  পাশাপাশি ইউরোপিয়ান কিংবা ল্যাটিন আমেরিকার খেলোয়াড়দেরও নজরে রাখছে ক্লাব গুলো। এছাড়া বিদেশি বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত খেলোয়াড়দেরকে দেশে ফেরাবার চেষ্টা চলছে। খেলোয়াড় তথা খেলার মান বাড়লেই দর্শকের টান বাড়বে বলে মত ফুটবল বিশেষজ্ঞদের। সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে ক্লাবগুলো।

বাফুফেও হয়ত তাদের ভুল বুঝতে শুরু করেছে। খেলা নিয়েছে ঢাকার বাইরে। দর্শক সমাগম বেশি ঘটে ঢাকার বাইরে। প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করতেই হয়ত এমন পদক্ষেপ। বাফুফে সফলতাও পেয়েছে। ক’দিন আগে করোনা পরিস্থিতি উপেক্ষা করা কুমিল্লার গ্যালারি ভরা দর্শক যেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলো দেশের ফুটবলের সোনালী অতীত। কুমিল্লা বাদেও মুন্সিগঞ্জ ও টঙ্গীতে চলছে প্রিমিয়ার লীগ ঢাকার পাশাপাশি। বেশকিছু পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বাফুফে। বিস্তর পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে বাফুফের নতুন পরিচালনা কমিটি। মাঠগুলোর উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন অত্যাধুনিক মাঠ তৈরীর আশ্বাস দিয়েছেন বাফুফে উর্ধতন কর্মকর্তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link