বিচিত্র কুসংস্কারের আজব সম্ভার

রাতের বেলা কাক ডাকলে তা হয় অশুভ। আবার চলার পথে কালো বিড়াল পথের মাঝে চলে আসলে তাও অশুভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা আমাদের জীবনে প্রতিটি পদক্ষেপে এমন সকল কুসংস্কারের সম্মুখীন হয়েছি নি:সন্দেহে। আমাদের মা-খালা, নানি-দাদিদের কাছ থেকেই আমরা এমন সব বিচিত্র সব কথা শুনেছি।

ফুটবলেও এমন সব কুসংস্কার সমর্থকরা মেনে চলেন, কোনকোন সময় তাঁরা সেগুলো মেনে চলতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত কিছুও করে ফেলেন।  যেমন ধরুণ, আমাদের সবার এমন একটা বন্ধু রয়েছে যে খেলা দেখতে বসলেই হেরে যায় দল। এমন বন্ধুকে আমরা সাধারণত টিভি সেট কিংবা মাঠের ত্রিসীমানার বাইরে রেখে খেলা দেখতে বসি। এমন নানা ধরণের ঘটনা কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত ঘটিয়ে থাকি কিংবা মেনে চলি।

কিন্তু খোদ খেলোয়াড় কিংবা কোচরা এমনকি পুরো একটা ফুটবল দল যদি এমন কুসংস্কার মেনে চলে তাহলে তা যেমন বিস্ময়ের সৃষ্টি করে তেমনি তা বিনোদনের একটা মাধ্যমেও কিন্তু পরিণত হয়। আজ এমন কিছু উদ্ভট বৈচিত্রময় ফুটবলীয় কুসংস্কার নিয়ে ক্ষুদ্রে এক আলোচনার পসরা সাজিয়ে নিয়ে এসেছি।

  • ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো (পর্তুগাল)

একাগ্রতা, কঠোর পরিশ্রম এবং শৃঙ্খলতা মেনে চলার এক অনন্য উদাহরণ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। তিনি যখন মাঠে নামেন লক্ষাধিক চক্ষুযুগল আটকে থাকে তাঁর দিকেই। বিশ্ব ফুটবলের এই কিংবদন্তিও বেশকিছু কুসংস্কার মেনে চলেন।

তার মধ্যে ফ্রি-কিকের সময় একটি স্ট্যান্স মেনে দাড়ানো তো এখন রীতিমতো একটা স্টাইলে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও এই খেলোয়াড় মাঠে নামার পূর্বে সবসময় ডান পা আগে দিয়ে নামেন সেই শুরু থেকেই।

তিনি তাঁর এই কুসংস্কার মেনেই হয়েছেন বিশ্বসেরা। তিনটি প্রিমিয়ার লিগ, পাঁচটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, দুইটি লা লিগা, একটি সিরি আ রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। এছাড়াও রয়েছে পাঁচটি ব্যালন ডি’অর।

  • কোলো তোরে (আইভরি কোস্ট)

আইভরি কোস্টের এই খেলোয়াড় তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনে সবার শেষে মাঠে নামার মতো এক অদ্ভুত কুসংস্কার মেনে চলেছেন। তাঁর এমন নিয়ম মেনে চলায় তাঁকে একবার বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এক ম্যাচে মধ্য বিরতির সময় তাঁর এক সতীর্থ চিকিৎসাধীন ছিলেন।

তিনি তাঁর সেই সতীর্থর আগে মাঠে নামতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে ছাড়াই ম্যাচ শুরু করে দেন ম্যাচ অফিসিয়ালসরা। পরবর্তীতে তোরে রেফারির অনুমতি ব্যতীত মাঠে প্রবেশ করলে রেফারি তাঁকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে এমন আচরণের জন্য সতর্ক করেন।

  • ইয়োহান ক্রুইফ (নেদারল্যান্ডস)

ফুটবলে নতুন এক ধরণ ‘টোটাল ফুটবল’-এর প্রবর্তক ডাচ ফুটবলার ইয়োহান ক্রুইফ ছিলেন মাঠের খেলায় অসাধারণ এবং অনবদ্য, বেক্তিগত জীবনেও তিনি এমন। তাঁর মতো এক কিংবদন্তিও খেলোয়াড়ি জীবনে মেনে চলেছেন বহু কুসংস্কার। অদ্ভুত এক কাজ তিনি করতেন নিয়মিত।

খেলার পূর্বে তিনি তাঁর আয়াক্স অ্যামস্টারডাম সতীর্থ গোলরক্ষক গেরট বলসের পেটে চাপড় মেরে মাঠে নামতেন। তারপর সময়-সুযোগ বুঝে তিনি প্রতিপক্ষের গোলবারের সামনে গিয়ে আগে থেকে চিবিয়ে রাখা চুইংগাম ফেলে আসতেন। একবার তিনি তাঁর এই অদ্ভুত নিয়ম পালন করতে ভুলে যান এবং সেবার আয়াক্স ৪-১ গোলয়ে বিধ্বস্ত হয়।

  • পেলে (ব্রাজিল)

বিশ্ব ফুটবলের মেগাস্টার পেলেও তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনে কুসংস্কারকে উপেক্ষা করতে পারেননি। ক্যারিয়ারের একটা সময় তিনি গোল খড়ায় ভুগেছিলেন বেশ কিছু দিন যাবৎ। তাঁর মনে হয়েছিল যে তাঁর একটি নির্দিষ্ট জার্সির জন্যে তিনি আর গোল করতে পারছেন না।

কারণ, তিনি তাঁর একটি জার্সি এক সমর্থককে দিয়েছিলেন উপহার হিসেবে কোন এক ম্যাচ শেষে। পরবর্তীতে তাঁর এই অফ ফর্মকে মাথায় রেখে তিনি তাঁর ওই জার্সিটি খুঁজতে তাঁরই এক বন্ধুকে দায়িত্ব দেন। তাঁর সেই বন্ধু তাঁকে সেই জার্সিটি খুঁজে এনে দেন, আর আবার পেলে গোল করতে শুরু করেন।

প্রকৃতপক্ষে তাঁর বন্ধু সেই জার্সি আর খুঁজে পাননি। তিনি পেলেকে তৎকালীন ব্যবহৃত একটি জার্সি দিয়ে বলেন যে এটাই সেই সমর্থককে উপহার দেওয়া জার্সি। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।

  • সার্জিও গয়কোচিয়া

আর্জেন্টাইন ফুটবলের অন্যতম সেরা ট্রাইবেকার গোলকিপার ধরা হয় সার্জিও গয়কোচিয়াকে। তিনি এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসেছিলেন ১৯৯০ এর বিশ্বকাপে। তিনি ট্রাইবেকারের আগে মাঠেই মূত্রবিসর্জন করতেন কুসংস্কার হিসেবে।

পরবর্তীতে তিনি এ বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে জানান যে, যুগোস্লোভিয়ার বিপক্ষের ম্যাচে তাঁর টয়লেটে যাওয়া অত্যন্ত জরুরী হয়ে পরেছিল। কিন্তু খেলার নিয়মানুসারে তিনি ট্রাইবেকারের আগে মাঠের বাইরে যেতে পারতেন না। তাই তিনি মাঠেই মূত্রত্যাগ করে ফেলেন। তিনি সেই ম্যাচে হিরো হয়ে ম্যাচ জিতিয়ে নেন। সেই থেকে তিনি েই রীতি মেনে চলতে শুরু করেন এবং প্রত্যেক ট্রাইবেকারের আগে মাঠেই মূত্রত্যাগ করতেন এই কিংবদন্তি।

  • ফ্রান্স জাতীয় দল

১৯৯৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্স ছিল এক তারকায় ঠাসা দল। জিনেদিন জিদান, দিদেয়ের দেসচ্যাম্পস সহ আরো অনেক তারকা ছিলেন সেই দলে। বিশ্বকাপের পুরোটা সময়জুড়ে একাধিক কুসংস্কার মেনেছিলেন পুরো ফ্রান্স দল।

বড় কুসংস্কারের সূত্রপাত ঘটান দলের সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার লরেন্ট ব্ল্যাঙ্ক। খেলা শুরুর আগে তাঁর সতীর্থ গোলরক্ষক ফ্যাবিয়ান বার্থেজের টাক মাথায় চুমু দিতেন ব্ল্যাঙ্ক। পরবর্তীতে ফলাফল নিজেদের পক্ষে আসা শুরু করলে পুরো টিম ফ্যাবিয়ানের মাথায় চুমু খেতে শুরু করে। এছাড়াও তাঁরা প্রতিদিন বাসে নির্দিষ্ট সিটে বসেই মাঠে যেতেন এবং খ্যাতিমান গায়িকা গ্লোরিয়া গাইনরের ‘আই উইল সারভাইভ’ গানটি শুনতেন ড্রেসিং রুমে বসে। এসকল কুসংস্কার মেনে সেবার বিশ্বকাপ জিতেছিল ফ্রান্স।

ফুটবলের ইতিহাসে এমন কুসংস্কার মেনে চলা আজ নতুন নয়, অনেক আগে থেকেই এমনটা হয়ে আসছে। ভবিষ্যতেও হয়ত আরো অদ্ভুত কোন কুসংস্কার অনুসরণ করার গল্প তৈরি হবে, আবার হয়ত আমরা হাজির হয়ে যাবো আরো একটি তালিকা নিয়ে। আপনার দৈনন্দিন জীবনে কুসংস্কার কতটুকু মেনে চলবেন তা নাহয় আপনার উপরই ছেড়ে দেওয়া যাক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link