বহু ত্যাগ, বহু সংযম আর অধ্যাবসায় প্রয়োজন একটা বিশ্বকাপ জেতার জন্যে। সেই সাথে প্রয়োজন প্রতিটা সদস্যের মধ্যে সমন্বতাও বেশ প্রয়োজন। এই যে যেমন ব্রাজিলের উদাহরণই টেনে নিয়ে আসা যায়। এবারের বিশ্বকাপে কাগজে-কলমে ব্রাজিল দলটা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। তাছাড়া নাম ও দামের ভারেও বাকি সবার চাইতে অনেকটাই এগিয়ে সেলেসাও শিবির। তবুও দিনশেষে তাদের ফিরতে হয়েছে রাজ্যের হতাশা নিয়ে।
ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রেও ঘটেছে ঠিক একই রকম ঘটনা। তবে মুদ্রার অপরপিঠে অবস্থান করছে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। নামের ভারে আর্জেন্টাইন স্কোয়াডে সবচেয়ে বড় তারকা ছিলেন খোদ মেসি। বাদবাকি সবাই এখনও সেই তারকা খ্যাতির প্রথম সারিতে নেই। তবুও দলটা এবার বিশ্বসেরা। এর পেছনের সবচেয়ে বড় কারণ দলটির একত্মতা।
আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি এই জায়গাটায় সবচেয়ে সফল কোচদের একজন। তিনি তাঁর গোটা দলটাকে একটি সুতোয় বাঁধতে পেরেছিলেন। তিনি পুরো দলকে বোঝাতে পেরেছিলেন, যে দলগত নৈপুন্যতাই কেবল পারে তাদেরকে বিশ্বকাপ শিরোপা জেতাতে। তিনি দলের প্রতিটা খেলোয়াড়দের সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করেছেন। তাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন। সৌদি আরবের বিপক্ষে অপ্রত্যাশিত হারের পরও দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে গোটা দল।
মেসি টেনেছেন দলকে। এ কথা বলে দেওয়া যায়। তবে দলে থাকা বাকিরাও নিজেদের আপ্রাণ চেষ্টাটাই করে গেছেন নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু বিপরীত চিত্রের দেখা মিলেছে এবারের রানার্সআপ দল ফ্রান্সের মধ্যে। দলটির মধ্যে অন্তরকোন্দলের আভাস টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। বিশ্বকাপ পরবর্তী সময়ে সেটা আর তীব্র হয়েছে। বিশ্বকাপের পরপরই ফ্রেঞ্চ স্কোয়াডের খেলোয়াড় থেকে শুরু করে কোচের সাথে হওয়া তিক্ততার খবর বাইরে আসছে ক্রমশ।
এবারের বিশ্বকাপে ফ্রেঞ্চ দলের আক্রমণের অন্যতম সেনানী ভাবা হচ্ছিল করিম বেনজেমাকে। যদিও তিনি ইনজুরি আক্রান্ত হয়ে পড়েন টুর্নামেন্টের শুরুতে। এরপর তিনি দলের সাথেই থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জোর গুঞ্জন আছে কোচ দিদিয়েন দেশ্যম তাঁকে দলে সাথে রাখতে রাজি হননি। তাইতো বেনজেমা ফিরে যান মাদ্রিদে। আর বিশ্বকাপে খেলা হয়ে ওঠেনি তাঁর। বহু আগে থেকেই দেশ্যম ও বেনজেমার মধ্যে স্নায়ুবিক দ্বন্দ বিদ্যমান। তবুও সদ্যই ব্যালন ডি’অর জয়ী খেলোয়াড়কে বাদ রেখে বিশ্বকাপ স্কোয়াড সাজানো দুষ্কর।
তবে তিক্ততা বেশিক্ষণ আর দমিয়ে রাখা যায়নি। বিশ্বকাপ শেষ হওয়া মাত্রই নিজের ক্ষোভের প্রকাশ জানালেন বেনজেমা। যদিও তিনি সরাসরি কোন বক্তব্য প্রকাশ করেননি। বেনজেমা ছাড়াও বেঞ্জামিন পাভার্ডকে ঘিরে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের পরেই বেশ সমালোচনা সহ্য করতে হয় পাভার্ডকে। তাও আবার কোচ দেশ্যমের কাছ থেকে। সেই সমালোচনা ভালভাবে নিতে পারেননি পাভার্ড। দলের অনেকের মত, এরপর থেকেই তিনি দলীয় পরিবেশে নেতিবাচকতা ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন।
এমন বিশৃঙ্খলার ফলাফলটা হাতেনাতে পেয়েছে ফ্রান্স তথা দিদিয়ের দেশ্যম। অনন্য এক উচ্চতায় চলে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগটা তিনি হাতছাড়া করেছেন। তিনি তাঁর দলটাকে একটা বিন্দুতে নিয়ে আসতে পারেননি। ইনজুরি জর্জরিত স্কোয়াডটায় সবচেয়ে বড় ভূমিকাটা রাখতে হত তাঁরই। তবে তিনি সেখানটায় হয়েছেন ব্যর্থ। লিওনেল স্ক্যালোনি কিংবা হার্ভে রেনার্ডরা ঠিক এ কারণেই বিস্ময়ের জন্ম দিয়ে থাকেন। তাঁরা বোঝেন সংবদ্ধ থাকা আর একটি স্বপ্ন লালন করাটা ঠিক কতটা জরুরি।
বাংলায় বেশ প্রচলিত একটা প্রবাদ রয়েছে, ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি-জিতি নাহি লাজ’। কিংবা ‘দশের লাঠি একের বোঝা’। এই সবকিছুই একতাবদ্ধ থাকার বার্তা বহন করে। দিনশেষে কেউ একা বিশ্ব জয় করতে পারে না। সেজন্য প্রয়োজন একটি ভরসা করার মত দল আর একই স্বপ্ন দেখা কিছু স্বপ্নবাজ। তবেই তো কয়েক যুগের প্রতীক্ষার অবসান ঘটানো যায়।