নট ওয়েল বেকড

একটু কল্পনা করুন। আপনি ছয় ঘন্টায় ২৪১ করলেন। মনের আনন্দে বাড়ি ফিরছেন। আপনার সতীর্থ গাড়ি চালাচ্ছে। আপনি পাশের আসনে। হয়তো বন্ধুর সাথে আলোচনা করছেন, ‘আজ রাতে উল্লাস টা জমবে ভালো। এবার টেস্ট দলের দরজা টা আবার খুললেও খুলতে পারে।’

কিন্তু বিধি বাম। মাঝ রাস্তায় গাড়ি গেল উল্টে। যিনি চালাচ্ছিলেন তিনি তো সাথে সাথেই মৃত। আর আপনি বেঁচে গেলেন। কিন্তু গুরুতর ছোট লাগলো। এবং এমনভাবে, যে আপনি আর কখনো ক্রিকেটই খেলতে পারবেন না। ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটেছিলো একই কাউন্টির দুই প্রবাদপ্রতিম ক্রিকেটারের সঙ্গে। ৩৩ বছরের ব্যবধানে। প্রথম জনের ডান হাত এমনভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, যে ২৮ বছর বয়সেই তাঁর ক্রিকেট জীবনে তালাচাবি পরে যায়।

দ্বিতীয়জনের একটা চোখের দৃষ্টি নষ্ট হয়ে যায় পাকাপাকিভাবে। এবং কি আশ্চর্য্য, দ্বিতীয়জনেরও দুর্ঘটনার সময় বয়েস ছিল ২৮। সমাপতন বললে কম বলা হয়। প্রথমজনের নাম ফ্রেড বেকওয়েল , দ্বিতীয় জনের নাম কলিন মিলবার্ন। এবং দুজনেই যে কাউন্টির হয়ে ক্রিকেট খেলতেন তার নাম নর্দাম্পটনশায়ার। ২ নভেম্বর, ১৯০৮ সালে এই প্রথম ব্যক্তিটি জন্মেছিলেন।

বর্তমান ক্রিকেটপ্রেমীকে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাটিং স্টান্স কার জিজ্ঞেস করলে, একনি:শ্বাসে উত্তর দেবেন – শিবনারায়ন চন্দরপল। কেউ কেউ ফাওয়াদ আলমের কথাও বলবেন। আর সবচেয়ে অদ্ভুত গ্রিপ কার জিজ্ঞেস করলে কিছুক্ষণ ভেবে হয়তো ফাফ ডু প্লেসিসের নাম করবেন।

ডানহাতি ব্যাটার ফ্রেড বেকওয়েল ছিলেন এই দুজনের মিশেল। যদিও তিনি যখন খেলতেন, তখন চন্দরপল বা ডু প্লেসিস, কেউই জন্মান নি। উইজডেন তাঁর স্টান্স সম্পর্কে যা লিখেছে, তাঁর বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, পৃথিবীর সবচেয়ে দু-চোখো স্টান্স। তাঁর ডান কাঁধ নাকি ব্যাটিং করার সময় প্রায় মিড-অনের সাথে সমান্তরাল থাকতো। আর দাড়াতেনও অনেকটা ঝুঁকে।

আর গ্রিপটাও অদ্ভুত। বটম হ্যান্ড ও টপ হ্যান্ডের মাঝে বেশ খানিকটা গ্যাপ। ঠিক যেমন ফাফ ডুপ্লেসির থাকে। দূর থেকে কেউ দেখলে হয়তো তাঁকে গাছ কাটতে উদ্যত কাঠুরে বলে ভুল করবেন। এই ধরণের স্টান্স আর গ্রিপ একইসাথে নিয়ে কোনো ব্যাটারই খুব একটা চোখের আরামের উদ্রেক করবেন না। চন্দরপল করতেন না, আলম করেন না।

ডু প্লেসিস শক্তিশালী ব্যাটিং করেন, কিন্তু গ্রেসফুল একেবারেই নন। এবং ফ্রেড বেকওয়েল এখানেই রহস্যময়। এই ধরণের স্টান্স ও গ্রিপ নিয়েও চরম সুন্দর ব্যাটিং করতেন। মাত্র ২০ বছর বয়সেই নর্দাম্পটনের হয়ে খেলা শুরু করেন। নর্থাম্পটনশায়ার তখন কাউন্টি ক্রিকেটে অত্যন্ত ছোট একটি দল। তাঁদের হয়ে খেলেও মাত্র ২৩ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট খেলা সহজ কথা নয়। কাট ও ড্রাইভ দুটোই চমৎকার মারতেন বেকওয়েল। আর শর্টলেগে দারুণ ফিল্ডারও ছিলেন। ব্যাটার হিসাবে চরম ডাকাবুকো ছিলেন বেকওয়েল।

১৯৩৩ ছিল তাঁর সোনার মৌসুম। পরপর দুই ম্যাচে নর্দাম্পটনশায়ারের হয়ে সর্বোচ্চ প্রথম শ্রেণীর স্কোরের রেকর্ড তৈরি করেন। প্রথমে নটিংহ্যামশায়ারের বিরুদ্ধে ২৪৬। পরের ম্যাচে গ্ল্যামোরগানের বিরুদ্ধে ২৫৭। এই প্রথম ইনিংসটি যাঁরা প্রতক্ষ্য করেছেন, তাঁরা বলেন, নর্দাম্পটনের মাঠে ওই ২৪৬ এর চেয়ে ভালো ইনিংস খেলা হয়নি। ওই ২৪৬ তিনি করেন ৬ ঘন্টায়। একসময় এতটাই পিটছিলেন, যে নটিংহ্যামের এক অফস্পিনার সব ফিল্ডার লেগসাইডে রেখে সমানে লেগ-স্টাম্পে বল করে যাচ্ছিলেন।

বেকওয়েল সম্ভবত লেগ-সাইডের ফিল্ডারদের খেয়াল করেননি। অফ-সাইডের বিঘে-বিঘে ফাঁকা রিয়েল এস্টেটই বোধহয় তাঁকে বেশি আকৃষ্ট করে। কাজেই লেগ-স্টাম্পের বাইরে সরে গিয়ে শুরু করলেন যথেচ্ছ ড্রাইভ আর কাট। দরিদ্র অফস্পিনার দেন ৩০ ওভারে ১৭৭। এই ১৯৩৩ সালেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে নিজের একমাত্র টেস্ট সেঞ্চুরিটি করেন ওপেন করতে নেমে।

ভারতেও খেলতে এসেছেন জার্ডিনের দলের হয়ে ১৯৩৪ সালে। মাদ্রাজ টেস্টে তাঁর একটা ৮৫ রয়েছে। জার্ডিনের কথা যখন উঠলোই, তখন বেকওয়েলের আরেকটা ছোট্ট উপাখ্যান শোনানোর লোভ সামলানো যাচ্ছে না। জার্ডিন যখন ইংল্যান্ড অধিনায়ক ছিলেন, কোন খেলোয়াড় কেমন বিচার করার একটা সহজ ফর্মুলা ছিল তাঁর। এ ইয়র্কশায়ারের সাথে কেমন করেছে। একবার ইয়র্কশায়ারের সাথে নর্দাম্পটনের খেলার আগে, কেউ বেকওয়েল কে মনে করিয়ে দেন, ‘ফ্রেড তোমার তো ইয়র্কশায়ারের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি নেই।’

বেকওয়েল নির্লিপ্ত ভাবে বললেন, ‘তাই নাকি? ঠিক আছে আজ করে ফেলবো।’ এরপর ব্যাট করতে নেমে প্রথম ওভারেই মারলেন ৫টি ৪। তৃতীয় ওভারে আরো ৩টি। দু ঘন্টা ব্যাট করে করেন ৯৬। সম্ভবত সেঞ্চুরিও হয়ে যেত, মিড-অনে একটা দারুন ক্যাচ তাঁকে না ফেরালে। ১৯৩৫ সালে খেলেন শেষ টেস্ট। আরো খেলতেই পারতেন। ৬ টেস্টে ৪৫ গড় ছিল তাঁর। কিন্তু ১৯৩৬ সালে সেই দুর্ঘটনার শিকার হলেন যেটার কথা ওপরে লিখলাম।

তাও আবার সদ্য ২৪১ করে বাড়ি ফেরার সময়। এই ঘটনার পর আর কোনো ধরণের ক্রিকেটই খেলতে পারেননি তিনি। অন্তরালে চলে যান। কলিন মিলবার্ন তো জনজীবনে, লাইমলাইটে মৃত্যুর আগে অব্দি ছিলেন। ধারাভাষ্য দিয়েছেন। কিন্তু ফ্রেড বেকওয়েল একেবারেই হারিয়ে যান। ১৯৮৩ সালে মারা যান বেকওয়েল। ক্রিকেটের পিচে ফ্রেড যতই ‘ওয়েল বেক্ড’ ব্যাটিং করে থাকুন, স্বয়ং বিধাতাই বোধহয় তাঁর জীবনটা খুব অসাবধানে বেক করেছিলেন। তাই তাঁকে নিয়ে কি হয়েছের জায়গায় আলোচনা হয় কি হতে পারতো নিয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link