২০১৮ সালে লিভারপুল যখন ৮৪ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে সাউদাম্পটনের ডিফেন্ডার ভার্জিল ভ্যান ডাইককে দলে ভিড়িয়েছিল, তখন সমালোচনা হয়েছিল অনেক। সেই সময়ের সবচেয়ে দামী ডিফেন্ডারের তকমা লেগে গিয়েছিল তখন পর্যন্ত অখ্যাত এই ফুটবলারের গায়ে।
কিন্তু অ্যানফিল্ডে পা রাখার পর মাঠের খেলাতেই সমালোচকদের জবাব দিয়েছিলেন ভ্যান ডাইক, বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কেন তার জন্য এতগুলো পয়সা খরচ করেছে লিভারপুল।
অ্যানফিল্ডে আসার পূর্বে ছিলেন সাদামাটা একজন ডিফেন্ডার, এরপর ইয়ুর্গেন ক্লপের কোচিং আর অল রেড ভক্তদের শক্তিতে বদলে গিয়েছেন তিনি। এখন প্রজন্মের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার ভার্জিল ভ্যান ডাইক। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ভরসাযোগ্য আর টেকনিকালি সলিড সেন্টারব্যাকদের মাঝে একজন তিনি।
১৯৯১ সালের ৮ই জুলাই পৃথিবীতে পা রেখেছিলেন ভার্জিল ভ্যান ডাইক। দক্ষিণ নেদারল্যান্ডসের ব্রেডা শহরে তার জন্ম, এখানেই বেড়ে উঠা। তবে অন্য অনেক ফুটবলারের মত একেবারে ছোট বেলাতেই ফুটবল একাডেমিতে খেলা শুরু করেননি ভ্যান ডাইক। নিজের আঠারো বছর বয়সে তিনি ভিলেম ২ ক্লাবের যুব দলে যোগ দেন।
একবছর সেখানে থাকার পর নেদারল্যান্ডসের শীর্ষ স্তরের ক্লাব গ্রনিঙ্গেনের যুব দলে চলে আসেন ভ্যান ডাইক। এখানে আরো এক বছর কাটানোর পরেই প্রথমবারের মত পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয় ভ্যান ডাইকের। ২০১১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত স্বদেশী ক্লাবটির হয়েই খেলে যান তিনি।
২০১৩ সালে স্কটল্যান্ড পাড়ি জমান ভার্জিল ভ্যান ডাইক। স্কটিশ ক্লাব সেল্টিকের জার্সি গায়ে জড়িয়ে খেলেন দুইবছর। ক্লাবটির হয়ে তিনি স্কটিশ প্রিমিয়ারশিপ জয় করেন। এছাড়া এই ক্লাবে থাকাকালীন দুই মৌসুমেই বর্ষসেরা টিম অব দ্য সিজনে অন্তর্ভুক্ত হন। সেল্টিক অধ্যায়ের দ্বিতীয় মৌসুমে স্কটিশ লিগ কাপও জয় করেন ভ্যান ডাইক। সেল্টিকের হয়ে ১১৫ ম্যাচ খেলে ১৫ গোল আর ৭ অ্যাসিস্ট করেছিলেন ভ্যান ডাইক।
স্কটল্যান্ড আর নেদারল্যান্ডসে খেলার সময়েই ভ্যান ডাইকের প্রতিভা নজরে এসেছিল ইউরোপের ক্লাবগুলোর। আর ২০১৫ সালে তাকে সরাসরি ইংল্যান্ডে নিয়ে আসে সাউদাম্পটন। তিনবছর এখানে থাকেন এই ডাচ। এইসময় ৭৯ ম্যাচে দলের রক্ষণভাগ সামলানোর দায়িত্ব পালন করেছেন ভ্যান ডাইক। কোন অ্যাসিস্ট না পেলেও সাতবার জালের দেখা পেয়েছিলেন সাউদাম্পটনের এই ডিফেন্ডার।
শেষপর্যন্ত ২০১৮ সালে ইয়ুর্গেন ক্লপ তাকে নিয়ে আসে লিভারপুলে, এরপরের গল্প তো সবার জানা। মাঝারি মানের ডিফেন্ডারকে রীতিমতো সেরাদের একজন বানিয়ে তুলেছে অ্যানফিল্ড। নিজের প্রথম বছরেই ভ্যান ডাইক ২০১৮ উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তবে গোলরক্ষকের ভুলে সেবার শিরোপা্র কাছ থেকেই ফিরে আসতে হয়েছিল।
তবে পরের বছর আবারও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে উঠে যায় ইয়ুগেন ক্লপের শিষ্যরা। ২০১৯ সালের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হয়েছিলেন ভ্যান ডাইক। আর পুরো মৌসুম জুড়ে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখানো ভ্যান ডাইক উয়েফা বর্ষসেরা খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এছাড়া ব্যালন ডি-অরের মঞ্চে অল্পের ব্যবধানে রানার আপ হয়েছেন সেবার। নিজের অভিষেক মৌসুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরষ্কার উঠেছে তার হাতেই। আর এসবকিছুর প্রভাব পড়েছিল ট্রান্সফার মার্কেটেও। ডাচ সেন্টারব্যাকের মার্কেট ভ্যলু একটা সময় ছিল মাত্র ১০ মিলিয়ন ডলার কিন্তু লিভারপুলে যোগ দেয়ার এক মৌসুম পরেই সেটা বেড়ে ১০০ মিলিয়ন ডলার হয়ে যায়।
এখন পর্যন্ত অল রেডদের হয়ে ১৮১ ম্যাচ খেলেছেন ভ্যান ডাইক। ডিফেডার হয়েও ১৬ গোল আর ১১টি অ্যাসিস্ট আছে তার নামের পাশে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেদারল্যান্ডসের হয়ে ২০১৫ সালের ১০ অক্টোবর অভিষেক হয় তার। সেসময় দলে নিয়মিত না থাকলেও লিভারপুলে আসার পর থেকেই ডাচদের কমলা জার্সির পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। ম্যাথিউজ ডি লিটের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজের দেশকে খেলার মাঠে রক্ষা করেন ডাইক। দেশের জার্সিতে এখন পর্যন্ত ৪৭ ম্যাচে মাঠে নামা ভ্যান ডাইক আপাতত ম্যাচ খেলার অর্ধশতক পূরনের অপেক্ষায় আছেন।
ভ্যান ডাইক একজন পরিপুর্ন ডিফেন্ডার বটে। দীর্ঘদেহ, দুর্দান্ত ট্যাকলিং সেন্স, বল দখল করার অবিশ্বাস্য সক্ষমতা, স্কিল আর ভিশন মিলিয়ে তিনি তাঁর নিজের পজিশনে বিশ্বের সেরাদের একজন হয়ে উঠেছেন। ধারাবাহিক পারফরম্যান্স এবং মাঠের লড়াকু মনোভাবের কারনে অ্যানফিল্ড ভক্তরা তাকে ভালবেসে ফেলেছে।
ডিফেন্ডার হয়ে মেসি কিংবা রোনালদোর সঙ্গে ব্যালন ডি-অর জেতার প্রতিযোগিতা করা প্রায় অসম্ভব বটে। আর সেই কাজটাই করেছেন ভার্জিল ভ্যান ডাইক, অবশ্য জিততে পারেননি শেষ পর্যন্ত। তবে তার সামর্থ্য প্রমানে এতটুকু ঢ়ের। লিভারপুলের হয়ে সম্ভাব্য সব শিরোপা জেতা হয়ে গিয়েছে তার। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা, লিগ কাপ, এফএ কাপ সহ সব কিছু জেতার স্বাদ পেয়েছেন ১.৯৩ মিটার উচ্চতার এই ফুটবলার।
এত এত সাফল্যের পরেও ভার্জিল ভ্যান ডাইক যদি তার লিভারপুল অধ্যায়ের দিকে ফিরে তাকান তাহলে নিজেকে দুর্ভাগা ভাবতেই পারেন। কারন তার এই চার বছরের সময়কালে তিনবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল খেলে দুইবারই মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়তে হয়েছে।
দুইবার মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধানে লিগ শিরোপা হাতছাড়া করতে হয়েছে ম্যানচেস্টার সিটির কাছে। অথচ ভাগ্যের একটু সুদৃষ্টি ফেলে হয়তো তিনবার করে ঘরোয়া এবং ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জিততে পারতেন সময়ের অন্যতম সেরা এই ডিফেন্ডার। কি জানি, এসব নিয়ে আক্ষেপ হয়তো নিজের মনে বয়ে বেড়াচ্ছেন ভার্জিল ভ্যান ডাইক।