শুরুতেই একটা ডিসক্লেমার দিয়ে রাখি – আমি শচীন টেন্ডুলকারের ভক্ত নই, কোনদিন ছিলাম না। যাদের খেলা দেখেছি এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে আমার পছন্দ সাবেক কালের ভিভিএস লক্ষ্মণ ও ব্রায়ান লারা এবং আধুনিক যুগে বিরাট কোহলি। ব্যাটসম্যান কত রান করল তার চেয়ে কিভাবে করল সেটাই আমাকে প্রভাবিত করে বেশি।
সে যাই হোক, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি বলুন রুচি, ফ্যাশন বলুন ফ্যাশন, বদলায়! তবে রাজনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা যতটা কমন, আমার ধারনা ছিল খেলার ক্ষেত্রে ততটা নয়। ধারনাটা হয়ত ঠিক কিন্তু তবু ভারতের এক ক্রিকেটার সম্বন্ধে আজকাল বেশ কিছু লেখা চোখে পড়ছে। তিনি শচীন টেন্ডুলকার।
আমার নিজস্ব ধারণা শচীনকে আমরা একসময় একটু তাড়াতাড়িই গ্রেটনেসের তকমা দিয়ে দিয়েছিলাম। তবে এটাও ঠিক যে পরবর্তীকালে শচীন নিজের গ্রেটনেস প্রমাণ করে ছেড়েছেন। ইন ফ্যাক্ট, অনেকটা নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই হয়ত মেনে নিতে বাধ্য হব যে সব মিলিয়ে ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানের নাম শচীন টেন্ডুলকার। আর কিছু নয়, অনেকটা স্যার ডনেরই মতো, রেকর্ড বই ঘাঁটলেই কথাটার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
প্রথম দিকে শচীনের ব্যাটিং গড় আহামরি কিছু ছিল না। সুনীল গাভাস্কারের মতো দুর্দান্ত, বিস্ফোরক স্টার্ট তাঁর হয় নি। সম্ভবত ২৩ তম টেস্টে গিয়ে ওনার গড় ৪০ ছাড়ায়! তেমনই, শচীনের ক্যারিয়ারের শেষের দুই বছরও ওনার স্ট্যান্ডার্ডে বেশ খারাপ। শেষ পর্যন্ত শচীনের গড় গিয়ে দাঁড়ায় ৫৪’র থেকেও একটু কম যদিও একসময় তা ৫৯ ছুঁয়েছিল। কিন্তু এর মাঝখানে ওনার পারফর্মেন্স আশ্চর্যরকম ধারাবাহিক। একটা ব্যাটসম্যানের সেরা সময় যদি ২১ থেকে ৩৫ ধরা হয় তাহলে নি:সন্দেহে শচীনের সেই সময়ের গড় ৬০ ছাড়িয়ে যাবে।
তবে এবার আসল প্রসঙ্গে আসা যাক। অনেকের অভিযোগ শচীনের চতুর্থ ইনিংসের গড় রান মাত্র ৩৬। তাঁর ক্যারিয়ারের গড়ের চেয়ে অনেকটাই কম। সেখানে সুনীলের গড় ৬৩। এই বিষয়ে আরও আলোচনা করার আগে আরও কিছু মহান ব্যাটসম্যানের চতুর্থ ইনিংসের গড় দেখে নেওয়া যাক।
‘আধুনিক ব্র্যাডম্যান’ খ্যাত স্টিভেন স্মিথের ৩০.৬৮ – কিন্তু শুধুমাত্র এইজন্যে বিরাটকে কেও স্মিথের চেয়ে বড় ব্যাটসম্যান বলে না। বিরাটের চতুর্থ ইনিংসের গড় কিন্তু প্রায় ৫০।
চতুর্থ ইনিংসে লারার গড় ৩৫.১২, রাহুল দ্রাবিড়ের ৪০.৩৮, জ্যাক ক্যালিসের ৪১.৬৩, বীরেন্দ্র শেবাগের ৩১, এবি ডি লিলিয়ার্সের ৩৮, কুমার সাঙ্গাকারার ৪২ এবং স্বয়ং ডন ব্র্যাডম্যানের ‘মাত্র’ ৭৩.৪ – ওনার ক্যারিয়ার গড়ের চেয়ে প্রায় ২৭ রান কম। বলার মানে – চতুর্থ ইনিংসে কম গড় হওয়াটাই স্বাভাবিক কারণ চতুর্থ ইনিংসের গড় টোটাল স্কোরও অনেক কম হয়। অথচ অন্যদের বেলায় এই বিষয়ে তেমন হইচই শোনা যায় না।
এবার সানির প্রসঙ্গে আসি। মেনে নিচ্ছি তাঁর চতুর্থ ইনিংসের গড় প্রায় অতিমানবিক। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও সত্যি যে তাঁর প্রথম ইনিংসের গড় ৪২-এরও কম! সেখানে এই গড় বয়কটের ৪৮, শেবাগের ৫৮, ম্যাথু হেইডেনের ৫৫, গ্রাহাম গুচের ৪৬। অথচ একজন ওপেনারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ চতুর্থ ইনিংসের নতুন বল নয়, ম্যাচের প্রথম ইনিংসে তরতাজা ফাস্ট বোলারদের নতুন বলের বিরুদ্ধে ভালো ব্যাট করা। সুতরাং এটা কি বলা যায় যে উনি সেই কাজে নিজের সময়কার এবং পরের বেশীরভাগ নামকরা ওপেনারদের থেকেই খারাপ ফল করেছেন?
চতুর্থ ইনিংসের আসল চ্যালেঞ্জ নতুন বল খেলা নয়, ভাঙা উইকেটে স্পিনারদের খেলা। সেদিক দিয়ে সানির এডভান্টেজ এই যে ওরা বল করতে আসার আগেই উনি মোটামুটি সেটেল হয়ে যাওয়ার সুযোগ পেতেন। তাছাড়া উনি যখন চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট শুরু করতেন তখন উইকেটের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো থাকত।
অন্য সব ক্ষেত্রে কিন্তু শচীনের রেকর্ডে কালি লাগার অবকাশ নেই – দেশের চেয়ে তাঁর বিদেশে গড় ভালো, সব দেশের বিরুদ্ধেই ৪০-এর ওপর গড় (এবং সব দেশের মাটিতেও), টেস্ট এবং ওয়ান ডে দুটোতেই তিনি সমান স্বাচ্ছন্দ্য (আমার তো মনে হয় ওয়ান ডে তে আরও বেশি), এবং ক্যারিয়ারে ১৪ বার ম্যাচ সেরার পুরস্কার তিনি পেয়েছেন (সানি পেয়েছেন ৫ বার)।
সানি আর শচীনের ম্যাচ সেরা পারফর্মেন্স তুলনা করলেও দেখা যাবে শচীন পিছিয়ে নেই। এই ম্যাচগুলোর মধ্যে চার বার ভারত জিতেছে, তিন বার হেরেছে। ড্র ম্যাচের মধ্যে ১৯৯০ সালের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে শচীন সেঞ্চুরি না করলে ভারত নির্ঘাত হারত। যে তিনবার ভারত হেরেছে সেই তিনবারই তিনি প্রায় একাই লড়াই করেন ভারতের হয়ে – ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অসাধারণ ১৩৬; ১৯৯৯-২০০০ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দুই ইনিংসে ১১৬ ও ৫২ (সেই ম্যাচে ভারতের মোট রানের ৩৯% রান শচীনের ব্যাট থেকে আসে); ২০০০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৯৭ (ম্যাচের দুই দল মিলিয়ে দ্বিতীয় হাইয়েস্ট স্কোর ছিল ৫০)।
সানির পাঁচটা ম্যাচ সেরা পারফরমেন্সের মধ্যে ভারত জেতে নি একটাতেও, হেরেছে একটাতে। তবে সেই হারের জন্যে সানিকে দোষ দেওয়া যাবে না কোনোমতেই। কারণ সেই ইনিংসটি ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যাঙ্গালুরুতে ৯৬ রানের – স্পিনের বিরুদ্ধে ঘূর্ণি উইকেটে অল টাইম গ্রেট ইনিংস। আর ওভালে মহাকাব্যিক ২২১ করার পরও যে ভারত জেতেনি তার দায়ও সানির নয়। তবু সব মিলিয়ে বোধহয় শচীনের চেয়ে সানিকে এগিয়ে রাখা গেল না এই নিরিখেও।
এই লেখার উদ্দেশ্য শচীনকে বড় করা বা সানিকে ছোট করা নয়। বক্তব্য একটাই – মাইক্রোস্কোপ নিয়ে দেখলে সব ক্রিকেটারেরই কিছু না কিছু ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যাবে (শুধু ক্রিকেটারই বা বলছি কেন, অবতারেরও)। কিন্তু শুধুমাত্র একটা বা দুটো কারণে তাঁদের গ্রেটনেস নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না, তোলা উচিৎও নয়।
সানি, কপিল, সচিন, রাহুল বা কুম্বলের মত ক্রিকেটাররা রোজ রোজ জন্ম নেন না। আমরা যারা ওঁদের খেলা মাঠে বা টিভির সামনে বসে দেখার সুযোগ পেয়েছি তারা যে ভাগ্যবান সেটা মেনে নিতে অসুবিধে কোথায়?