ঢুসটা মারার পর জিদান কয়েকমুহুর্ত তাকিয়েছিলেন মার্কো মাতেরাজ্জির চোখের দিকে। সারাবিশ্বের সমস্ত ক্যামেরা তখন ফোকাস করে রেখেছে চকচকে টাকমাথার ভদ্রলোকের দিকে। বিশ্বের সবচেয়ে নন্দিত খেলোয়াড়ের ঐ মস্তিষ্ক যা কিনা দুটো ম্যাজিকাল পায়ের ছোঁয়ায় গুঁড়ো করে দিয়েছে নক আউটে সর্বশ্রেষ্ঠ সেলেকাও বাহিনীকে সেই মস্তিষ্কই ঘটিয়ে ফেলল এক নিন্দিত অপরাধ!
ক্যামেরার ফোকাস গেল আরও কাছে, দুটো শান্ত চোখ দেখছে মাটিতে কাতরাতে থাকা মাতেরাজ্জিকে- সারাবিশ্ব তোলপাড় করেও দুটো চোখ তখনও শান্ত- তাবড় তাবড় মনোবিদ, সাংবাদিক, ফুটবলব্যক্তিত্ব এই ঘটনার ১৪ বছর পরেও সমাধান করতে পারেনি ঐ চোখের সংকেত।
যে জিদান নিজের ক্যারিয়ারে বরফের মতো মস্তিষ্ক নিয়ে মাঝমাঠে মাটি ধরালেন বিশ্বের প্রায় সমস্ত ডিফেন্সকে তিনি জীবনের শেষ ম্যাচে, যা কিনা বিশ্বকাপ ফাইনাল এবং আটানব্বই বিশ্বকাপ নয় কারণ সেখানে জিদানকে নিজের ছন্দে পায়নি বিশ্ব পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে কিন্তু যে ২০০৬ বিশ্বকাপে তিনি ততক্ষণে নায়ক হয়ে গিয়েছেন- সেই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে সেই মাহেন্দ্র ক্ষণে কীভাবে এমন করতে পারেন জিজু? ফ্যামিলি স্লেজিং? সে কি সারা ক্যারিয়ারে কম সহ্য করেছেন তিনি? না তো!
এর উত্তর ফিরে যায় কোনো এক দীর্ঘদেহী রাজপুত্রের দুটো মন্ত্রপুত হাতের কাছে। কয়েক মিনিট আগের ঘটনা। ফ্রান্সের রাইটব্যাক স্যাগনলকে বলটা বাড়িয়ে বক্সে ঢুকে গেলেন জিদান, অব্যর্থ সেন্টার, সেখান থেকে ধনুকের ছিলার মতো শরীর বাঁকিয়ে বুলেটের মতো হেড করলেন পড়ন্তবেলার ফুটবল জিনিয়াস। বার্লিনের গ্যালারি একমুহুর্তে যেন ঝলসে উঠল গোলের আনন্দে কিন্তু জিজু দেখলেন একটা সোনালী শরীর, বাঁক খেয়ে উড়ন্ত বলটাকে সপাটে পাঞ্চ করে উড়িয়ে দিলেন পোস্টের ওপর দিয়ে!
কেউ খেয়াল করেছিলেন কিনা জানিনা জিদানের অভিব্যক্তি, ঐ প্রথম এত বছরের স্বপ্নের ক্যারিয়ারে জিদান বিরক্তিতে চেঁচিয়ে উঠলেন, যেন অর্জুনের গাণ্ডীবের সামনে অসহায় কর্ণ! এবং তাঁর ক্যারিয়ারের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে বর্ণময় যুদ্ধতে – ঘটনার কি আশ্চর্য সমাপতন!
সেদিন রোমে বিশ্বকাপটা এসেছিল ঐ চওড়া গ্লাভসে, জিদান নিতে পারেননি ঐ অব্যর্থ লক্ষভেদের পরেও গোল না হওয়াটা। কিন্তু এখানেই তো জিয়ানলুইজি বুফন নামক বিষ্ময়ের শুরু, যার ঐ দুটো হাতে থমকে আছে ফুটবলের অনেক জটিল সংকেত। ১৯৯৫ সালে পারমা যখন অভিষেক ঘটালো ছোট্ট বুঁফোর তখন বয়স মাত্র ১৭, মিলানের সাথে একম্যাচে পনেরোটা সেভ করে চলে এলেন লাইমলাইটে আর সাফল্য?
পেলে একবার বলেছিলেন ১৯৮৬-এর ম্যারাডোনাকে দেখেছিলাম একা বিশ্বকাপ জেতাতে কিন্তু তিনি তো আপফ্রন্টের খেলোয়াড়, কিন্তু একজন গোলরক্ষক যদি একা ট্রফি দিতে পারেন এই দুনিয়ায় তাঁর নাম নির্দ্বিধায় জিয়ানলুইজি বুফন! পারমাকে দিলেন কোপা ইতালিয়া, উয়েফা কাপ।
আজ ক্রিশ্চিয়ানো কিংবা নেইমার-এমবাপ্পেদের ট্রান্সফার ফি নিয়ে এত কথা হয় অথচ ২৩ বছরের বুঁফোকে জুভেন্তাস ২০০১ সালে নিয়ে এসেছিল রেকর্ড ট্রান্সফার ফির বিনিময়ে। ২০০১ সালে যার দাম ছিল ৫২ মিলিয়ন ইউরো!
জুভেন্তাস বুঁফোকে দিয়েছিল ভালবাসা, বুঁফো ভরিয়ে দিলেন জুভেন্টাসের ট্রফি ক্যাবিনেট। ১২ বার ইতালির সেরা গোলরক্ষক, নয় বার সিরি ‘এ’ চ্যাম্পিয়ন হল জুভেন্টাস!
বিশ্বকাপ থেকে ইউরো রানার্স-আপ, ইতালিতে মালদিনি-কানাভারো-চিয়েল্লিনি জমানা অবধি রক্ষণের শেষ অতন্দ্র প্রহরী হয়ে থাকলেন ফ্লোরেন্সের পাশে মফঃস্বলে বেড়ে ওঠা ছেলেটা। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে মাঠে নামলেন ১৭৬ বার যা ইতালির বিশ্বরেকর্ড, আজও!
অস্থির সময়ে ঝড় ওঠে পৃথিবীতে, সে ঝড়ের ঢেউয়ে চেপে ধেয়ে আসে জিদান থেকে গাউচো, রোনালদো থেকে মেসি শুধু সমস্ত ঝড়ের সামনে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন বুঁফো। ইতিহাসকে কোথাও গিয়ে থমকে দাঁড়াতে হয়, যেভাবে থমকে দাঁড়িয়েছিল জিদানের সেই গোলার মতো হেডটা।
সেই বাঁকেই দাঁড়ান বুঁফো ,তাঁর হাতে এসে থামে ইতিহাস, তিনি সেই পাণ্ডুলিপি কুড়িয়ে লিখতে শুরু করেন নতুন ইতিহাস। ইব্রাহিমোভিচ একবার বলেছিলেন জুভান্ট সের প্র্যাকটিসে থুরাম-ক্যানাভারোর ডিফেন্স ভাঙতে পারত গুটি কয়েক স্ট্রাইকার, আর যারা পারত তারাও নিশ্চিত হয়ে যেত গোল হবে না।
ফ্লোরেন্সের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে, ইতালির শিল্পী শহরে বসন্ত আসছে একটু একটু করে, পড়ন্ত বেলার বুঁফো শক্ত করে বেঁধে নিচ্ছেন নিজের গ্লাভসজোড়া, নতুন শতাব্দীতে তাঁর লেখা ইতিহাস বই হয়ত তুলে দেখবে অন্য কেউ, যে ইতিহাসে থমকে আছে অসংখ্য রথী-মহারথীরা, পৃথিবীর সমস্ত বহমান ইতিহাস যেখানে থমকে দাঁড়ায়, ফিস্ট হওয়া বলের মতো বাঁক নেই নিজস্ব ছন্দে।
তার প্রতি পাতা উল্টোলে নীল দিগন্তে কোথাও ফুলের আগুন লাগবে, সেই রঙিন বসন্তে ঝলমল করে উঠবে প্রেমের শহর, দ্য ভিঞ্চির দেশ- এক শিল্পীর সারাজীবনের রং লেগে থাকবে বসন্তের ইতালি জুড়ে।