গভীর রাত পর্যন্ত জেগে টিভি দেখাটা রিফাতের বহুদিনের অভ্যাস। আমি আর আমার মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার অনেক পরে ও ঘুমায়।
নতুন বাসা নিয়েছি। কয়েকদিন ভালো পরিশ্রম গিয়েছে। আমি ঘুমাতে যাওয়ার আগে রিফাত খুব করে বললো, ‘তামান্না আজকে একটু পরে ঘুমাও প্লিজ। আমার-আজ একা একা টিভি দেখতে ভালো লাগবে না।’
আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম, ‘আমার শরীর খারাপ লাগছে। আজকে তোমার টিভি দেখে কাজ নেই। তুমিও বরং আজ ঘুমিয়ে যাও৷’
ও মন খারাপ করে বললো, ‘তুমি তো জানোই আমার এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে না৷ আচ্ছা তুমি ঘুমাও। সমস্যা নেই।’
.
আমি আর কথা না বাড়িয়ে ওকে এক কাপ চা বানিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি রিফাত বিছানায় নেই। একটু অবাক হলাম। ও কখনোই আমার আগে ঘুম থেকে উঠে না। আমারই বহু কষ্টে ওর ঘুম ভাঙাতে হয়। দেরিতে ঘুমায় বিধায় সকালে উঠতে দেরি হয় ওর। ভাবলাম হয়তো ওয়াশরুমে গিয়েছে। আমিও ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমের দিকে গিয়ে ওকে ডাক দিলাম। কিন্তু ওয়াশরুমের দরজা হালকা ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো। ও ওয়াশরুমে নেই। আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। দ্রুত ড্রয়িংরুমে গেলাম। ও হয়তো টিভি দেখতে দেখতে সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমি ড্রয়িংরুমে গিয়ে আরও বেশি অবাক হলাম। যখন দেখলাম রিফাত মেঝেতে অগোছালোভাবে পরে আছে। আমি ওকে ক্রমাগত ডেকেই চলেছি । ও কোনো জবাব দিচ্ছে না। আমার কান্নাকাটির আওয়াজ পেয়ে আমার তিন বছরের মেয়েটার ঘুম ভেঙে গেলো৷ আমাকে এত সকালে কান্না করতে দেখে ও ভয়েই কেঁদে দিলো।
খুব অসহায় বোধ করছি৷ আমরা সবে নতুন এলাকায় এসেছি। এখানকার রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না৷ রিফাতের জ্ঞান কোনোভাবেই ফিরছে না৷ আমাদের মা মেয়ের কান্নাও থামছে না। চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। রিফাতের কিছু হয়ে গেলে আমরা কিভাবে বাঁচবো। বারবার আফসোস হতে লাগলো কেন আমি কাল রাতে ঘুমাতে গেলাম? কেন ওর সাথে থাকলাম না! কেন বুঝতে পারলাম না ওর কি হয়েছে। কখন জ্ঞান হারিয়েছে, কি দেখে জ্ঞান হারিয়েছে কিছুই বুঝতে পারছি না। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে।
কাউকে কল দিবো এমন অবস্থাও নেই৷ আমার মোবাইল গতকাল হারিয়ে গেছে। রিফাতের ফোন চেক করে দেখলাম ব্যালেন্স শূন্য। এত সকালে কোনো ফ্লেক্সিলডের দোকান খোলা থাকার কথা না৷ আর দোকান কোনদিকে সেটাও জানি না।
আমি সাত-পাঁচ না ভেবে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম কোনো গাড়ির আশায়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে বহুকষ্টে একটা রিকশা পেলাম৷ আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া। সেই রিকশাওয়ালার সহযোগিতায় রিফাতকে হাসপাতালে ভর্তি করালাম।
আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। রিফাতের জ্ঞান এখনও ফেরেনি৷ ওর বেডের কাছে বসে ওর মায়াভরা চেহারাটার দিকে তাকিয়ে খুব কান্না পাচ্ছিলো৷ অস্থিরতা কিছুতেই কাটছিলো না। আমার মেয়ে রিফতি বারবার বাবা বাবা বলে ডেকেই যাচ্ছে। রিফাত কোনো উত্তর দিচ্ছে না। এই দৃশ্য সহ্য করার মতো না। আমি রিফতিকে কোলে নিয়ে কান্না করছি। কিছুতেই নিজেকে শক্ত করতে পারছি না।
একটা প্রশ্ন আমাকে বারবার ভাবিয়ে তুলছে। রিফাতের কি এমন হলো যে এভাবে অজ্ঞানই হয়ে গেলো? ওর শারীরিক কোনো সমস্যা নেই। একজন সুস্থ সবল মানুষ। কোনোদিন একটু জ্বর পর্যন্ত হয় না। সেই মানুষের কি এমন হলো যে জ্ঞানই হারিয়ে ফেললো ! আমার কৌতুহলও কাজ করছে খুব।
ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি হয়েছে ওর? কেন জ্ঞান হারিয়েছে?’ ডাক্তার সমস্বরে বললো, ‘আমরাও ঠিক ধরতে পারছি না। তবে আমার মনে হয় কোনো বিষয় নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ভুগছিলেন অথবা কোনো কিছু দেখে ভয় পেয়েছিলেন।’
আমি অবাক হলাম! একই ঘরে থেকে ওর দুশ্চিন্তার কারণ আমি জানি না! ও তো আমাকে সব শেয়ার করে৷ আর ভয় পাওয়ার মতোই বা কি দেখেছিলো ও? বাসাটায় কোনো সমস্যা নেই তো?
.
ডাক্তার বলেছেন এক ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে অন্য হাসপাতালে ভর্তি করাতে। আমি আল্লাহর নাম নিয়েই যাচ্ছি। সব উনার হাতে। জীবনে এতটা অসহায় বোধ করি নি যতটা আজকে করছি।
এক ঘন্টা পর রিফাতের জ্ঞান ফিরলো। জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই প্রথম যে বাক্যটা সে বললো তা হলো, ‘বার্সেলোনা ৮ টা গোল খাইলো ক্যামনে ম্যান!’