উপমহাদেশে ক্রিকেট কি শুধুই খেলা? নাহ, এটা খেলার চেয়ে অনেক বেশি একটা আদর্শ, একটা জাতীয়তাবাদ। কেউ কেউ বলেন জীবনধারা। আর জীবনের সাথে অনেক বেশি ক্রিকেট মিশে যাওয়ার ভাল দিক যেমন আছে – তেমনি আছে খারাপ দিকও। ক্রিকেটে জাতীয়তাবাদ যত বেশি মিশে, তাতে তত বেশি উগ্রবাদ আসারও সুযোগ হয়।
তেমনই একটা অধ্যায়ের স্মৃতিচারণা করা যাক। দিনটা ছিল ১৩ মার্চ, ১৯৯৬। সেটার মঞ্চ ছিল ঐতিহাসিক ইডেন গার্ডেন্স, ভালবাসার শহর কলকাতায়। বিশ্বকাপের আসর, সেমিফাইনালের ম্যাচ – স্বাগতিক ভারতের প্রতিপক্ষ সেবারের ডার্ক হর্স শ্রীলঙ্কা – উত্তেজনার পারদ তখন তুঙ্গে।
কে জানতো, সেই পারদেই যে আগুন জ্বলবে ইডেনের গ্যালারিতে!
হ্যাঁ, সত্যি সেদিন আগুন জ্বলেছিল। না, উত্তেজনার আগুন নয়। ক্ষিপ্ত দর্শক উগ্র হয়ে গ্যালারিতে আগুন লাগিয়েছিল। বোতল, ফলমূল-সহ মাঠে যে যা পারছিল ছুঁড়ে মারছিল। মাঠে খেলাটাই দু’দলের খেলোয়াড়দের জন্য বীভৎস এক অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় তো ছিলই।
ম্যাচ রেফারি ক্লাইভ লয়েড যেমন দৃশ্যগুলো নিজের চোখ দিয়ে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ম্যাচটা চালানোর চেয়ে, শেষ করতে পারার চেয়ে একটা সময় খেলোয়াড়দের নিরাপত্তাটাই বড় দুশ্চিন্তা হয়ে ওঠে তাঁর জন্য।
ম্যাচটা তিনি বাতিল করে দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে বিজয়ী ঘোষণা করে দিতে বাধ্য হন। প্রথমবারের মত, আইসিসি বিশ্বকাপের নক আউট পর্বের এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ দর্শকদের উগ্রতায় পণ্ড হল। ক্রিকেটের চূড়ান্ত কুৎসিত দৃশ্যটা সেদিন মাঠে দেখা যায়।
শুরুটা অবশ্য সেদিনের ম্যাচে ‘ভাল’ দিয়েই হয়েছিল। প্রথমবারের মত সেমিফাইনালে ওঠা শ্রীলঙ্কা দল বিপদে পড়ে শুরুতেই। সনাথ জয়াসুরিয়া এক, রমেশ কালুভিতারানা ০ ও আসাঙ্কা গুরুসিনহা এক রান করে ফিরে যান সাজঘরে।
তখনই উইকেটে আসেন ‘ম্যাডম্যাক্স’ অরবিন্দ ডি সিলভা। তিনি ৪৭ বলে ৬৬ রান করেন ১৪ টি চারের সৌজন্যে। সাথে রোশান মহানামার হাফ সেঞ্চুরি, অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা,হাশান তিলকারত্নে ও চামিন্দা ভাসদের ছোট্ট কিন্তু কার্যকর কিছু ইনিংসে বোর্ডে ২৫১ রান জড়ো করে লঙ্কানরা।
নিজেদের মাটিতে খেলা বলে, তখনও ম্যাচ থেকে পুরোপুরি ছিটকে যায়নি ভারত। জবাব দিতে নেমে দলীয় আট রানে ওপেনার নভজোৎ সিং সিধু সাজঘরে ফিরে গেলেও স্বয়ং শচীন টেন্ডুলকার ছিলেন। তাঁর ৬৫ রানের ইনিংসে ভর করে একটা সময় এক উইকেট হারিয়েই ৯৮ রান তুলে ফেলে ভারত।
কিন্তু, এরপরই বিধিবাম। শ্রীলঙ্কার ‘ভাল’র পর এবার ভারতের ‘মন্দ’ সময়ের দেখা মিললো। ২২ রান তুলতেই সাতটি উইকেট হারায় ভারত। রীতিমত পানির মত উইকেট হারাতে থাকে ভারত। ১২০ রানে আট উইকেট হারিয়ে যখন নিশ্চিত ভাবে হারের মুখ দেখার অপেক্ষায় ছিল ভারত – তখনই ভারতের দর্শকদের আচরণ নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
প্রথমে ম্যাচ বন্ধ করা হয়, পরে আর শুরু করা যায়নি। ম্যাচে জয়ী ঘোষণা করা হয় শ্রীলঙ্কাকে। ভাল ও মন্দের পর চূড়ান্ত কুৎসিত চিত্রায়নে শেষ হয় ঐতিহাসিক সেই ম্যাচ। ফাইনালে ওঠে চারদিন পর শিরোপা জিতে শ্রীলঙ্কা।
সেদিন যখন ভারত ১২০/৮ স্কোরে দাঁড়িয়ে সাজঘরে ফেরেন, তখন ১০ রান করে অপরাজিত ছিলেন বিনোদ কাম্বলি। কে জানে সেই অবস্থা থেকেও হয়তো নায়ক হয়ে উঠতে পারতেন তিনি। পারেননি, কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়েন! শুধু বিনোদ নয়, গোটা ভারতের জন্যই সেটা ছিল শোক ও লজ্জার একটি দিন!