সোনালি প্রজন্মের ‘ব্যর্থ’ পোস্টার বয়

ইডেন হ্যাজার্ড (শুদ্ধবাদী উচ্চারণ মতে এডেন অ্যাজার ধরনের কিছু)-কে চেলসির জার্সি গায়ে যেমন খেলতে দেখেছি তেমনটা আর কোথাওই দেখিনি। শুধুমাত্র স্কোর আর অ্যাসিস্টের পরিসংখ্যানের বাইরে গিয়েও খেলায় তাঁর প্রভাব আমাকে বরাবর মুগ্ধ করেছে। অসামান্য বল নিয়ন্ত্রণ, নিখুঁত ড্রিবলিংয়ে বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আর ডিসিশন মেকিংয়ের ভিত্তিতে এক সময়ে মেসি-রোনাল্ডোর যোগ্য উত্তরসূরিদের পংক্তিতে হ্যাজার্ডকে আমি সব সময়েই বাকিদের থেকে এগিয়ে রাখতাম।

বেলজিয়ামের জার্সি গায়ে ২০১৪ বিশ্বকাপ, ২০১৬ ইউরোর পারফরম্যান্স আমার খুব একটা মনে পড়ে না। কিন্তু স্মৃতিতে এখনও অমলিন ২০১৮ বিশ্বকাপের হ্যাজার্ড। সব কিছু ছাপিয়ে দুটো ম্যাচ, একটায় প্রতিপক্ষ ব্রাজিল, আর একটায় ফ্রান্স। একটায় জয়, আর একটায় পরাজয়।

ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, ২০১৮ কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে হ্যাজার্ডের পারফরম্যান্সকে একমাত্র ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ২০০৬ বিশ্বকাপে জিদানের সারা মাঠ জুড়ে রাজকীয় বিচরণের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। কিন্তু প্রায় রূপকথায় জায়গা করে নেওয়া জিদানের সেই খেলায় বিপক্ষ দল হিসেবে একেবারেই ছন্নছাড়া ছিল ব্রাজিল, পুরোই নিষ্প্রভ ছিলেন হলদে সবুজ জার্সির এক ঝাঁক তারকা। ২০১৮ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ০-২ গোলে পিছিয়ে থাকা তিতের ব্রাজিল বরং অনেকটা সময় জুড়েই আক্রমণের চাপ বাড়াচ্ছিল।

প্রথম অর্ধে জায়গা অদল বদল করে ওয়ান টু খেলতে খেলতে ব্রাজিলের মাঝমাঠকে মাঝে মধ্যেই মাটি ধরাচ্ছিলেন হ্যাজার্ড ও ডি ব্রুইন। দ্বিতীয়ার্ধে ব্রাজিলের আক্রমণ থেকে প্রতি আক্রমণে বল নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অসম্ভব ওয়ার্ক লোড নিতে থাকেন হ্যাজার্ড। একদম সেন্ট্রাল চ্যানেল দিয়ে পায়ে চুম্বকের মত বল নিয়ে একাধিকবার সর্পিল গতিতে এগিয়ে যেতে যেতে বিপক্ষের মারে ফাউল আদায় করাটা যেন একটা মজার খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছিল হ্যাজার্ডের কাছে।

পরিসংখ্যান বলছে এই ম্যাচে ১০০ শতাংশ সাফল্যের সঙ্গে দশটা টেক-অন করেছিলেন সেদিন হ্যাজার্ড। বিশ্বকাপের আসরে যা একটা অনন্য নজির। সেই ম্যাচে বেলজিয়ামের রক্ষণ ভেঙে সমতা ফেরাতে পারেনি ব্রাজিল, অন্য দিকে ব্রাজিল মিডফিল্ডার ও ডিফেন্ডারদের কার্যত একাই হাঁফ ধরিয়ে দিয়েছিলেন হ্যাজার্ড।

ঠিক পরের ম্যাচে সেমি ফাইনালে ফ্রান্সের সঙ্গে প্রায় একই রকম ক্ষিপ্রতায় খেলেছিলেন হ্যাজার্ড। তবে অতটা জায়গা জুড়ে তাঁকে খেলতে দেননি কান্তে, মাতুইদি, পোগবাদের মাঝমাঠ। তবুও একের পর এক ট্যাকল সামলে, বারবার পড়ে গিয়েও উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে যাচ্ছিলেন হ্যাজার্ড।

তার মধ্যেই একবার প্রথমার্ধে ফ্রান্সের রাইট ব্যাক বেঞ্জামিন পাভার্ডকে প্রায় সাঁতার কাটাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। দ্বিতীয়ার্ধে ০-১ গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় সমতা ফেরানোর লক্ষ্যে হ্যাজার্ডের অস্থির দৌড় বিব্রত করছিল ফ্রান্সের ডিফেন্সিভ ইউনিটকে।

মাতুইদি আর কান্তের দুটো মরিয়া ট্যাকল হ্যাজার্ডের পা থেকে ন্যায্য ভাবে বল ছিটকে দিলেও পেনাল্টি বক্সের ঠিক কাছে রেফারির একেবারে চোখের সামনে অলিভিয়ের জিরু-র বিশ্রী ফাউলে রেফারির অবিচলিত থাকা খুবই অবাক করেছিল! শেষ অবধি এই ম্যাচে বেলজিয়াম ফ্রান্সের দুর্ভেদ্য রক্ষণকে অতিক্রম করতে পারেনি। হ্যাজার্ডের নেতৃত্বাধীন বেলজিয়ামের ফাইনাল খেলার স্বপ্নের সেখানেই সমাধি।

এর পরের বছর ক্লাব কেরিয়ারের অন্যতম সেরা মরসুম উপহার দিলেও সেখানেই যেন শেষের শুরু। ফিটনেস সংক্রান্ত সমস্যা, খাদ্যাভ্যাস জনিত ট্রোলের শিকার আর ম্যাচের পর ম্যাচ বেঞ্চে কিংবা স্কোয়াডের বাইরে অপেক্ষা করা, এর বাইরে আর বলার মত তেমন কিছু নেই।

ইউরো ২০২১-এও তথৈবচ পারফরম্যান্স। আর এই বিশ্বকাপে? শ্লথগতির, বারে বারে বল হারানো, থমকে যাওয়া, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়া এক ভিনগ্রহের ইডেন হ্যাজার্ড। মাত্র ৩১ বছর বয়সেই আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে ইতি টানলেন বেলজিয়ামের তথাকথিত ‘ব্যর্থ’ সোনালি প্রজন্মের পোস্টার বয়। বিদায় ইডেন হ্যাজার্ড, বেলজিয়ামের জার্সিতে আপনার খেলা আর দেখা হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link