চ্যাপেলনীতি বনাম সৌরভবাদ: সৌরভ পরবর্তী ভারতীয় ক্রিকেট

তারুণ্য অবশ্যই একটা বড় ফ্যাক্টর। সঙ্গে ফিটনেস। গ্রেগ চ্যাপেল জমানা এই তারুণ্যের ধুয়ো তুলে সিনিয়রদের রাতারাতি বসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমার মতে, এটা অনেকটা তুঘলকি কারবার। সৌরভ গাঙ্গুলির ফিটনেস তখন পড়তির দিকে, চ্যাপেল যুগে। মহেন্দ্র সিং ধোনি তো সৌরভকে স্লো বলেই বাদ দিয়েছিলেন, সৌরভের রান আউটের ভিডিওগুলো দেখলেই সৌরভের লেজিনেস চোখে পড়ে।

কিন্তু, সবকিছুর একটা প্রসেস থাকে। চ্যাপেলের প্রসেস ছিল না। সৌরভের রানিং বিটুইন দ্য উইকেট খুব স্লো। সেখানে ধোনিরা অনায়াসে দু রানকে তিনে পরিণত করত। কিন্তু একটা মহাতারকার অবদানকে কখনওই অস্বীকার করা যায় না। সৌরভকে চ্যালেঞ্জ না করে অপমান না করে আলাদা করে বোঝানো যেত। ধোনিও দ্রাবিড় সৌরভ বিহীন ভারতকে অষ্ট্রেলিয়ায় ওয়ানডে জিতিয়েছিলেন। বুড়ো বলতে একা শচীন সেই টিমে। কিন্তু টিমে তারুণ্য আর ফিটনেসের শুরুটা সৌরভের হাত ধরেই হয়েছিল। লোকটার ক্রিকেটীয় প্রজ্ঞাকে অস্বীকার করা যায় না।

২০০৩ বিশ্বকাপে কুম্বলেকে বসিয়ে হরভজনকে খেলিয়ে গেলেন। ড্রেসিংরুমে কুম্বলেকে তেমনই সামলালেন সৌরভ। সেই সৌরভ অষ্ট্রেলিয়া সফরে ২০০৪ এ কুম্বলেকে নেওয়ার জন্য নির্বাচকদের সঙ্গে লড়ে গেলেন। ফলাফল সবার জানা। সৌরভের সময়েই তারুণ্যের জয়গান গাওয়ার শুরু কিন্তু পরিস্থিতি অনুযায়ী অভিজ্ঞতাকেও তিনি ব্যবহার করলেন। ভারতীয় ক্রিকেটে পরিবর্তনের শুরু ওনার হাত ধরেই। চ্যাপেলের হাত ধরে নয়। ধোনিরা সৌরভের লেগাসি বহন করেছে।

সত্যি বলতে কি ২০১১ বিশ্বকাপে শচীন টেন্ডুলকার ছাড়া আর একটা সিনিয়র থাকলে ইন্ডিয়া হয়ত কাপ পায় না। কিন্তু সৌরভকে সেই সম্মান আর সময়টা দিলে হয়ত উনি নিজেই ওয়ানডে থেকে সরে দাঁড়াতেন। আমার মনে হয় সেটা দেওয়া হয়নি। দ্রাবিড় লক্ষ্মণও ২০০৮ এর পর আরও ৫ বছর টেস্ট খেলেছেন। সৌরভও পারতেন। যদি উনি সেই সময়ের অধিনায়কের কাছ থেকে ভরসা আর সম্মানটা পেতেন। ইগোও সৌরভের বিপক্ষে গেছে। একসময় সৌরভ মন্তব্য করেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটে কিছু জুনিয়র আছেন যারা ব্যাটের থেকে চুলের স্টাইলের দিকে নজর দেন বেশি।

বুঝতে অসুবিধা হয় না তারা কারা। সৌরভ বরাবর স্পষ্ট বক্তা। কিন্তু কোথাও বুঝেশুনে বলতে হয়। পরিবর্তনের আবহাওয়া সৌরভের বুঝতে সময় লেগেছিল। আর অভিমান বুকে বয়ে বেড়ানো বাঙালিকে কেউ সেসময় বোঝেওনি। ধোনির টিমের ফিটনেস ২০১২ এর পর থেকে নিচের দিকে। কোহলি ফিটনেসসর্বস্ব হলেও রোহিত বুমরাকে কি বলবেন। সবার ফিটনেস কিন্তু কোহলির মতো নয়। কোহলি একটাই হয়। রোহিত স্কিলে চলেন। সেখানে ফিটনেস তার ক্রিকেট প্রজ্ঞায় খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি।

এরকম বহু ক্রিকেটার আছেন। যেমন ইনজামাম। শেওয়াগ, ম্যাকগ্রা। এরা যে ভীষণ ভালো ফিল্ডার বলা যায় না। স্কিলে বেরিয়ে গেছেন। ধোনি উইকেট কিপিংএর জন্য যে ফিটনেস দরকার সেটা ধরে রেখেছেন। বিশ্বক্রিকেটে ধোনির মতো ক্যালকুলেটিভ ক্রিকেটার খুব কম আছেন। ধোনি মাঠে সময় কম কাটান। অবজার্ভ বেশি করেন। পুরো পঞ্চাশ ওভার ব্যাট করার রিস্ক কখনও নেননি। বরাবর পাঁচ সাতে নেমে চালিয়ে খেলছেন যখন তখন বেশিরভাগ ওভার বেরিয়ে গেছে। ইন্ডিয়া ৩৫ ওভারে ৩ উইকেট রান ২২০ ধোনি নামছেন।

চালিয়ে খেলে রান রেট বাড়িয়ে রাখছেন। উপরের দিকে ব্যাটাররা যখন দ্রুত আউট হচ্ছে ধোনি নামতেন না। উনি শেষের দিকে নেমে চালিয়ে খেলে নট আউট থাকতেন। এটা হয়ত স্বার্থপরতা মনে হতে পারে কিন্তু ক্যালকুলেশনটা ভাবুন। উনি আত্মবিশ্বাসী শেষের দিকে নেমে চালিয়ে খেলে ম্যাচ বের করে দেবেন। এই ডিজাইনের ক্যালকুলেশনকে ধরতে না পারলে ওনাকে স্বার্থপর মনে হবে। উনি হয়ত ২৫/৩০ ওভার পরে নামছেন। চাপ নিচ্ছেন কম। উল্টে চাপ দিয়ে অন্য প্লেয়ারদের থেকে খেলা বের করে নিচ্ছেন।

ক্যালকুলেশনে ফিটনেস বাঁচাচ্ছেন। সারা মাঠে না ছুটে শুধুমাত্র উইকেটের পিছনে মনোযোগ দিয়ে অসাধারণ উইকেটে কিপং এর নমুনা রাখছেন। এগুলো ধোনির থেকে শেখার। মাঠে খুব বেশি না খেটে স্মার্টেস্ট ক্রিকেট কীভাবে খেলতে হয় সেটা শেখালেন আমাদের। সৌরভ ঠিক উল্টো, উনি চাপ নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন। সেভাবেই জিতেছেন। কিন্তু চাপ অনেক সময় চেপে বসে। ধোনির এই ক্যালকুলেশন শেষের দিকে খাটেনি। যে ক্লোজ ম্যাচ উনি বের করতেন, শেষের দিকে সেটা পারেননি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।

কিন্তু, ভুললে হবে না সেই সময়ের বোর্ড আর টিম ম্যানেজমেন্টকে পাশে পেয়েছে ধোনি। নয়ত ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ায় ৮-০ হারার পরে ওনার ক্যাপ্টেন্সি যাওয়ার কথা। প্রবল প্রতিপক্ষ গৌতম গম্ভীরও ধোনির সঙ্গে ঠান্ডা মাথার লড়াইতে হেরে টিম থেকেই বাদ গেলেন। আমার বরাবর মনে হয়েছে সৌরভকে সময় আর সম্মানটা সে সময় দিলে উনি নিজেই ওয়ানডে থেকে সরে দাঁড়াতেন।

কারো গাটস ছিল না ওনার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলার। সেজন্য ওনাকে অবাক করেই ড্রপ করা হয়েছিল আবার ধোনির আমলে। সবাই  শচীন হয় না যে বেছে বেছে সিরিজ খেলবে। শচীন সারাজীবন মুম্বাই লবিকে পাশে পেয়েছে। ধোনির ছিল শ্রীনিবাসন। সৌরভকে সারা ক্রিকেট জীবন বিভিন্ন বিরুদ্ধ স্রোতের বিরুদ্ধে লড়তে হল। আর একটু সম্মান ওনাকে দেখানো যেত সেই সময়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link