২০০২ সালের ন্যাটওয়েস্ট ফাইনাল যতবার দেখতে যাই, একটা কথা মনে হয় বারবার, সেদিন যে ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে ভারত নেমেছিল, সেঞ্চুরি ওপেনিং স্ট্যান্ডের পরে আচমকা কোলাপস কি তারই সাইড এফেক্ট ছিল? শচীন টেন্ডুলকার সেই টুর্নামেন্টে গোটাটাই চার নম্বরে খেলেছিলেন। দুটি সেঞ্চুরিও ছিল তাঁর চারে নেমে।
কিন্তু আমরা সবাই জানি, তাঁর সবচেয়ে সফল এবং উপযুক্ত পজিশন ওপেনিং। কি হতো যদি শচীন আর সৌরভ বা সেহবাগ ওপেন করতেন। তিন নম্বরে যিনি ওপেন করলেন না তিনি, তারপরে রাহুল? গোটা টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ৪৮ করা দীনেশ মোঙ্গিয়াকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পজিশন ওয়ান ডাউনে খেলানো কি খুব জরুরী ছিল? ভারত যুবরাজ কাইফের রূপকথার জন্য জিতে যায়, তারপরের ঘটনা সবাই জানেন।
কিন্তু যেটা চাপা পড়ে যায় সেটা হল দীনেশ মোঙ্গিয়ার ধারাবাহিক ব্যর্থতা। এখানেই শেষ নয়, তার পরের কয়েক মাসেও লাগাতার ব্যর্থতা সত্বেও মঙ্গিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় ২০০৩ বিশ্বকাপে। যদিও সেখানে ওপেন করেন শচীন এবং সৌরভ চলে যান তিনে। মোঙ্গিয়ার থেকে বিশেষ কিছু দল আশা করেছিল বলেও মনে হয়নি।
না তাঁকে দিয়ে বিশেষ বোলিং করানো হয়েছিল। ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে কব্জির মোচড়ের ঐতিহ্য বহনকারী ভিভিএস লক্ষ্মণ সেরা ওয়ানডে ফর্মে থাকা সত্বেও বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পাননি, দীনেশ মোঙ্গিয়ার জন্যে। এখন ভাবলে খারাপই লাগে। একটি বিশ্বকাপ খেলা অন্তত লক্ষ্মণের মত ব্যাটসম্যানের কি প্রাপ্য ছিল না?
বাবা কাকা দাদুদের অবশ্য মত একটু আলাদা। কবজির মোচড় বলতে তাঁরা লক্ষ্মণ বা তার পূর্বসূরি আজহারকে বোঝেন না। তাঁদের কাছে একমাদ্বিতীয়ম হলেন গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। যার স্টাইলিশ ব্যাটিং, অধিনায়ক থাকাকালীন সততার নজির, চোখ ধাঁধানো স্ট্রোক প্লের কথা আগের প্রজন্মের কাছে সর্বজনবিদিত।
স্বয়ং সুনীল গাভাস্কারের যিনি ভগ্নিপতি এবং সানির মতে, ভারতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্ট্রোক প্লেয়ার তাঁর জামাইবাবু ছাড়া আর কেউ নন। এহেন বিশ্বনাথের খেলা আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি বলাই বাহুল্য; তাই ইউটিউবই ভরসা। হয়তো আজহার আর লক্ষ্মনকে দেখার মাধ্যমে কিছুটা বুঝেছি তিনি কেমন খেলতেন। কিন্তু একটি অপ্রাপ্তি রয়েই গেছে; ১৯৮৩ বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্যদের মধ্যে তাঁর নাম নেই। অনেক চেষ্টা করেছি কারণ অনুসন্ধান করতে।
গাভাস্কারের প্রায় সমসাময়িক হয়েও কেনো প্রায় সাড়ে চার বছর আগেই খেলা থেকে সরে যেতে হল এমন একজন দৃষ্টিনন্দন ব্যাটসম্যানকে? অনেকে বলেন রিফ্লেক্স কমে গিয়েছিল, ফিটনেস ইস্যু ছিল। আগের পাকিস্তান সিরিজে ব্যর্থ হন। ৮৩ বিশ্বকাপে ভারতের ব্যাটিং অর্ডারে সবচেয়ে ব্যর্থ ছিলেন স্বয়ং সুনীল গাভাস্কার। বাকি সবাই ভাল পারফর্ম করেছিলেন, বিশেষ করে যশপাল শর্মা, মহিন্দর অমরনাথ।
সন্দীপ পাতিল, দিলীপ বেংসরকার ছিলেন মিডল অর্ডারে। তবুও পরে যখনই ভেবেছি, বিশ্বনাথের বিশ্বকাপ জয় প্রাপ্য ছিল বলেই মনে হয়েছে আমার। সব সময় কঠিন পরিস্থিতিতে ভাল খেলতেন এই ‘লিটল মাস্টার’। তাঁর অধিকাংশ ভালো ইনিংস সেঞ্চুরিতে পরিণতি পায়নি। আর তাঁর করা ১৪টি টেস্ট সেঞ্চুরির কোনোটাই ভারতের পরাজয়ের মুখ দেখেনি। এখানেও কোথাও লক্ষ্মণের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। লক্ষ্মণও ছিলেন তাঁর সময়ে দলের ক্রাইসিস ম্যান। বহু কঠিন ম্যাচ জিতিয়ে দিয়েছেন।
বিশ্বনাথ ৮২-৮৩র পাকিস্তান সফরে ব্যর্থ হলেও, ইন্টারনেট সূত্র অনুযায়ী বেশ কিছু ম্যাচে ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হন তিনি। সেই সময়ে পাকিস্তানি আম্পায়াররা কেমন ছিলেন, গ্যাটিং এর সাথে শকুর রানার কুখ্যাত ঝগড়া ইত্যাদি সবাই জানেন; তাই প্রমাণের প্রয়োজন নেই হয়তো।
ভাগ্যের পরিহাসে একজন বিশ্বকাপ জিততে পারলেন না, আরেকজনের বিশ্বকাপ খেলা হল না। বিশ্বনাথের প্রসঙ্গ আসতে তাই না চাইতেও আলোচনায় চলে আসেন তাঁর উত্তরসূরি লক্ষ্মণ। ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেট এদের ছাড়া বর্ণহীন।