বিশ্বনাথ, কবজির পেলব মোচড় ব্যাটে বলে। বল সীমাপার। পলকের আগে। স্মৃতিতে অম্লান।
গুন্ডাপ্পা রঙ্গনাথ বিশ্বনাথের টেস্ট অভিষেক হয়েছিলো সেই ১৯৬৯ সালে, কানপুরের গ্রিনপার্কে। মাঠটাকে চাইলে ভিশি মনে রাখতে পারেন, আবার ভুলেও যেতে পারেন। কারণ, এই সেই মাঠ যখানে ৫০০ তম টেস্ট খেলেছিল ভারত ২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে। সেবার বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) কর্তারা প্রায় সব সাবেক অধিনায়ককে (আগমার্কা থেকে দাগমার্কা – সবাই) এই উপলক্ষে ডেকে উঠতে পারলেও ডাক পাননি ভিশি।
কৈশোরের প্রথম ক্রিকেট ভালবাসাকে দ্বিতীয়বার অপমানিত হতে দেখে তীব্র ক্ষোভে পুড়ে গিয়েছিলাম সেদিন। প্রথমবার এটা হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। বিশ্বকাপ জিতে ফেরা নায়কদের দেখতে মুম্বাই বিমানবন্দরে জনতা তাঁর ট্রলির উপর দিয়ে চলে গিয়েছিল যেদিন। অবসৃত তিনিও ঐ কপিল-সানি-জিমি সহ নায়কদের সঙ্গেই ফিরছিলেন সেদিন ইংল্যান্ড থেকে।
১৯৮০ সালের গোল্ডেন জুবিলি টেস্টের (ভারত / ইংল্যান্ড) সেই অমর দৃশ্য মনে পড়ে? আম্পায়ারের ভুল নির্দেশে আউট হয়ে যাওয়া ইংল্যান্ড উইকেটরক্ষক বব টেলর কে (আসলে আউট ছিলেন না) মাঠে ফিরিয়ে এনেছিলেন ভারত অধিনায়ক গুন্ডাপ্পা রঙ্গনাথ বিশ্বনাথ।
ওই ঘটনাটার জন্যই ১০ উইকেটে ম্যাচটা হারে ভারত। ম্যাচটা সরকারীভাবে ইংল্যান্ড জেতে। আসলে ম্যাচটা জিতেছিল ক্রিকেট আর তার স্পিরিট। তখনো ক্রিকেট ছিল ভদ্রলোকের খেলা।
সারা জীবনের বাকি সব কীর্তি বাদ দিয়ে দিলেও (১৯৭৪ ইডেন টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসের ১৩৯ সহ), এই একটি ঘটনাই আমার কাছে গুন্ডাপ্পা রঙ্গনাথ বিশ্বনাথকে বিশ্ব ক্রিকেটের সুপার হিরো বানিয়ে রেখেছে – গত ৪১ বছর ধরে। ওটা থাকবে আজীবন।
ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর সাবেক অধিনায়ক বিশ্বনাথ। জোর দিয়ে বলতে পারি, অধিনায়ক বিশ্বনাথ নিজের অজান্তে অন্য অনেক অধিনায়কের চেয়ে উচ্চাসনে বসাটা পাকা করে ফেলেছিলেন ঐ একটি ঘটনায়। ওই আসনটায় কোনো নড়চড় হয়নি কখনো!
এই শিল্পী ব্যাটসম্যান মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন দর্শকদের, এমনকি বোলারদেরও। রেকর্ড টেকর্ড হয়ে যেত আপনা আপনি এবং তারাও মুগ্ধ হাতে গার্ড অফ অনার দিত ভিশিকে। তা এহেন বিশ্বনাথ, যার ব্যাটিংয়ের সময় ভারতে ঘড়ির কাঁটাও স্তব্ধ হয়ে যেত ‘শিল্প’ দেখতে, তাঁকে আজও খুব ‘মিস’ করে বিশ্বের আপামর ক্রিকেটপ্রেমী।
আর এর জন্য ৯১ টেস্টে তাঁর খেলা ১৫৫ ইনিংসে ১৪ টি শতক আর ৩৫ টি অর্ধ শতক সহ ৬০৮০ রান ছিল নিমিত্ত মাত্র। এছাড়াও ২৫ টি এক দিনের আন্তর্চাতিক ম্যাচে ভারতের হয়ে ২৩ ইনিংসে ২ টি অর্ধশতক সহ ৪৩৯ রান করেছিলেন তিনি। পরিসংখ্যান দিয়ে সবাইকে বোঝা যায় না, ভিশিকে তো নয়ই! তিনি ভারতীয় ব্যাটিংয়ের সর্বকালের সেরা স্টাইল স্টেটমেন্ট।
ভিশিকে দেখেই ক্রিকেটের প্রেমে পড়া আমার। সেই সুদূর ১৯৬৯ সালে। ৫২ বছর হয়ে গেল দেখতে দেখতে। তখন ক্রিকেটের প্রতিশব্দ ছিল শিল্প। এবং তার জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিলেন তিনিই। সে ঘোর ৫২ বছরেও কাটল না। আজও আছে ঘোরটা। থাকবে আজীবন।
আপনার জীবন মসৃণ হোক আপনার ঘোর লাগানো সেই সব লেট কাটগুলোর মত – সেই প্রত্যাশা করি সব সময়। ঠিক আপনার কভার ড্রাইভের মতই সুন্দর হোক সময়।