হ্যান্সি ক্রনিয়ের পতন সম্ভবত ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বজ্রপাত।
নব্বইয়ের দশক জুড়ে ক্রিকেটের ভদ্রতা, সুশীলতা এবং সভ্যতার সবচেয়ে বড় প্রতীক ছিলেন ক্রনিয়ে। স্পোর্টসম্যানশিপের জন্য তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সেই ক্রনিয়ের নাম যখন সিবিআইয়ের তদন্ত রিপোর্টে এলো, তখন অধিকাংশ মানুষ সেটা উড়িয়ে দিয়েছিলেন-এটা হতেই পারে না।
কিন্তু নাটকীয়তার বাকি ছিলো। খোদ ক্রনিয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করে বললেন, তিনি আসলেই অপরাধী। কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদে চুপ থাকার পর তাঁর এই স্বীকারোক্তি ক্রিকেট বিশ্বকে আক্ষরিক অর্থেই বজ্রাঘাতের মতো আঘাত করেছিলো।
ম্যাচ ফিক্সিং স্ক্যান্ডাল ফাঁসের ঠিক দুই বছর পর, ২০০২ সালের ১ জুন, দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রনিয়ে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ক্রিকেট থেকে বিতাড়িত হবার আগে হ্যানসি ক্রনিয়ে ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসসেরা ক্যাপ্টেনের মধ্যে একজন। অধিনায়ক হিসেবে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ৫৩ টেস্ট ও ১৩৮ ওয়ানডেতে।
ব্যাটিং অলরাউন্ডার হিসেবেও হ্যান্সি ক্রনিয়ের অবদান নেহাত কম নয় । সব ফর্ম্যাট মিলিয়ে ৯০০০ আন্তর্জাতিক রান আর ১৫৭ উইকেটের ঝুলি তাঁর ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধই করেছিল।
তবে আজকে আমরা জেনে নেব হ্যানসি ক্রনিয়ে সম্বন্ধে ১০ টা ‘ফ্যাক্টস’।
হ্যান্সি ক্রনিয়ে তাঁর পরিবারের ক্রিকেট খেলা দ্বিতীয় জেনারেশন ছিলেন। বাবা ইউই আর ভাই ফ্রান্সের তো ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলার রেকর্ডও আছে।
ব্যক্তিজীবনেও হ্যান্সি ক্রনিয়ে ছিলেন একজন অলরাউন্ডার। স্কুল জীবন থেকেই তিনি পড়াশোনা আর খেলাধুলা চালিয়ে যেতেন সমানে। ব্লুমফন্টেইনের গ্রে কলেজে তিনি ছিলেন প্রথম সারির একজন ছাত্র (কলেজের রীতি অনুযায়ী তাঁকে বলা হত ‘হেড বয়’) আর এর সাথেই কলেজেরই রাগবি আর ক্রিকেট দলের অধিনায়কও ছিলেন তিনিই।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে ক্রনিয়ে তাঁর ফার্স্ট ক্লাস ক্যারিয়ার শুরু করেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি ‘অরেঞ্জ ফ্রি এস্টেট’ এর অধিনায়কত্ব পান আর মাত্র ২৪ বছর বয়সেই সাউথ আফ্রিকার অধিনায়কত্ব করতে মাঠে নামেন।
হ্যান্সি ক্রনিয়ের ওয়ানডে অভিষেক ঘটে ১৯৯২ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে, যেটি কিনা ছিল খোদ সাউথ আফ্রিকারই বিশ্বকাপে অভিষিক্ত ম্যাচ। ক্রনিয়ের টেস্ট অভিষেকটা ছিল ভুলে যাওয়ার মতই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ম্যাচটাতে তিনি দুই ইনিংসে করেন ৫ আর ২, দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচটা হেরে যায় ৫২ রানে।
১৯৯৭ সালে তিনি আয়ারল্যান্ডের হয়ে আন-অফিশিয়াল ম্যাচ খেলেন (বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে) আর আয়ারল্যান্ড তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মত ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটের কোন দলকে হারায়। মিডলসেক্সকে হারানোর ঐ ম্যাচে তিনি ব্যাট হাতে ৯৪ রানের পাশাপাশি বল হাতে নেন ৩ উইকেট।
ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং তিন ডিপার্টমেন্টেই তিনি ছিলেন তুখোড়। শচীন টেন্ডুলকার তো একবার বলেছিলেন, একজন বোলার তাকে ঘাবড়ে দিতে পারেন আর তিনি হ্যানসি ক্রনিয়ে। টেন্ডুলকারের মতে ক্রনিয়েকে খেলার উপায়ই তাঁর জানা ছিল না। টেস্টে টেন্ডুলকার পাঁচবার ক্রনিয়ের বলে আউটও হয়েছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকাকে নেতৃত্ব দেওয়া ৫৩ টেস্টের ২৭ টা তেই তিনি জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন(হারতে হয়েছে ১১ ম্যাচে)। ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দেওয়া ১৩৮ ম্যাচের ৯৯ টা তেই তিনি জয়ী দলের অধিনায়ক!
ক্রনিয়ের সব অর্জন ধূলায় মিশে যায় যখন তিনি ২০০০ সালে ফিক্সিংয়ের অভিযোগে অভিযুক্ত হন। দিল্লী পুলিশের বিবৃতি মতে, তাঁরা লন্ডনের বুকি সঞ্জীব চওলা আর হ্যান্সি ক্রনিয়ের মধ্যে একটি ফোন কলের রেকর্ড পান । সেই অভিযোগের ভিত্তিতে ক্রনিয়ে আজীবন নিষেধাজ্ঞা পান। ক্রনিয়ে অবশ্য সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন তবে তা ধোপে টেকেনি।
জুন মাসের ১ তারিখে হ্যানসি ক্রনিয়ে বিমান দুর্ঘটনায় মাত্র ৩২ বছর বয়সে মারা যান। সেই দুর্ঘটনায় কার্গো বিমানটির দুইজন পাইলটও বাঁচেননি। তবে এমন কন্সিপিরেসি থিওরিও আছে, হ্যান্সি ক্রনিয়ে আসলে দুর্ঘটনায় মারা যাননি, তিনি খুন হয়েছিলেন।
ক্রনিয়ে মোট ৬৮ টেস্টে মাঠে নেমেছেন। করেছেন ৩৬.৪১ গড়ে ৩৭১৪ রান, নিয়েছেন ২৯.৯৫ এভারেজে ৪৩ উইকেট। ১৮৮ ওয়ানডেতে তিনি রান করেছেন ৩৮.৬৪ গড়ে ৫৫৬৫, উইকেট নিয়েছেন ৩৪.৭৮ এভারেজে ১১৪ টি। পুরো আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে তিনি আটটি সেঞ্চুরি আর ৬২ টি হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন।