এক মায়ের স্বপ্ন

সিডনি টেস্টে আলো কেড়েছেন হনুমা বিহারি।

টেস্ট ক্রিকেটটা তিনি খেলেছেন একেবারেই টেস্ট ক্রিকেটের মত করেই। এখন অবশ্য ইনজুরির খবরে তাঁর সাফল্য একটু আড়ালে চলে গেছে। তবে হনুমা বিহারি কিন্তু আসলেই বিসিসিআই ও টিম ম্যানেজমেন্টের আস্থার প্রতিদান দিচ্ছেন। ধীরে ধীরে নিজের পরিশ্রমের প্রাপ্য পাচ্ছেন তিনি। তবে হনুমা বিহারির এই যে উঠে আসা, আর এত এত অর্জনে ভেসে যাওয়া এর পেছনে একটা গল্প আছে। সেই গল্পটাই আজকে বলব বলে ভেবে রেখেছি।

হনুমা বিহারির উঠে আসার পেছনের কারণ দুটো। একটা হল তাঁর মা আর আরেকটা তিনি নিজেই। বিহারির বয়স যখন খুব অল্প, তখন তাঁর বাবা মারা যান। ছেলেকে নিয়ে তখন বিজয়লক্ষ্মীর মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। একে তো উপার্জনক্ষম সদস্যের মৃত্যু, তাঁর ওপর ছেলের চোখভরা স্বপ্ন। ছেলেকে পরিচর্যা করতে বিজয়লক্ষ্মী তখন যে কাজটা করলেন, তার চাইতে সাহসী মনে হয় আর কিছু হতে পারেনা- সেটা একটু পরেই বলছি।

হনুমা বিহারি ক্রিকেটকে ভালোবাসতেন একদম ছোটবেলা থেকেই। বাবা-মাও ছেলের এই ভালবাসা টের পেয়ে মাত্র আট বছর বয়সেই বিহারিকে নিয়ে গেলেন ভারতের খাম্মান জেলার এক ক্রিকেট একাডেমীতে। সেখানে কিছুদিন অনুশীলনের পর বিহারিকে ভর্তি করানো হয় সাবেক হায়দ্রাবাদি ক্রিকেটার নাগেশ হ্যামোন্ডের ক্রিকেট কোচিং-এ।

নাগেশ হ্যামোন্ডের চোখে বিহারির প্রতিভা নজর এড়ায়নি। তাই তিনি একদিন বিহারির বাবা মাকে ডেকে বলেন, বিহারিকে কে. জন মনোজের অধীনে অনুশীলন করাতে। বিহারির বাবা-মা নাগেশের কথা ফেলে দেননি। বিহারিকে মনোজের অধীনেই নিয়ে গেছিলেন। মূলত বিহারির শুরুর দিকের ব্যাটিং টেকনিক এই মনোজই ঠিক করে দিয়েছিলেন।

যায় দিন ভাল, আসে দিন খারাপ। হনুমা বিহারির মসৃণ জীবনের হঠাৎ বজ্রপাত এরপরই। সবকিছু যখন চলছিল ঠিকঠাক, এপারের মায়া ত্যাগ করে বিহারির বাবা পাড়ি দিলেন ওপারে। বিহারির বয়স তখন মাত্র ১১। সে সময় বিজয়লক্ষ্মীর সামনে মাত্র দুটি পথ খোলা ছিল- এক, বিহারির বাবা যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন সেখানে চাকরি নেওয়া অথবা দুই, মাসিক ২২ হাজার ভারতীয় রূপির বিধবা ভাতাতে কোন রকমে সংসার চালানো।

চাকরি করলে বিহারী থেকে দূরে থাকতে হবে, ১১ বছর বয়সী ছেলের স্বপ্ন তখন পূরণ নাও হতে পারে। বিজয়লক্ষী তাই বেছে নিলেন সবচেয়ে কঠিন রাস্তাটাই। তিনি পূর্ণ মনোযোগ দিলেন ছেলের স্বপ্ন লালনে, ক্রিকেটের উন্নতিতে। এই ক্রিকেটের উন্নতির জন্যে তিনি এক অভিনব কাজ করে ফেললেন। স্বামীর মৃত্যুর পর কর্মস্থল থেকে যে টাকা পাওয়া গেছিল তা দিয়ে তিনি কিছু জমি কিনে ফেললেন।

সে জমিতে সিমেন্ট দিয়ে তিনি বিহারীর অনুশীলনের জন্যে একটা উইকেটও তৈরি করে ফেললেন। কিন্তু, শুধু পিচ থাকলেই তো হবেনা। বিহারি অনুশীলনটা করবেন কিভাবে? সে সমস্যারও সমাধান করে ফেলেন বিজয়লক্ষী – ছেলের জন্যে একটা বোলিং মেশিনও কিনে ফেলেন তিনি। সংসারের টানপোড়েনে সে কাজটা কিন্তু তখন মোটেই সহজ ছিল না।

পরে নানা সাক্ষাৎকারে বিহারি বলেছেনও, ‘আমার মা ছিল ভয়ানক। তিনি কখনও সাহস হারাতেন না। তাঁর চরিত্রের মধ্যেই এটি ছিল।’

এভাবেই মায়ের সাহচর্যে চলতে থাকল ক্রিকেটে বিহারির পথচলা। তবে সে সাহচর্য প্রথমবারের মত সার্থকতার মুখ দেখল ২০১৮ সালের আগস্টে, যখন ইংল্যান্ডের সাথে বিহারির টেস্ট অভিষেক হয়ে গেল। ছেলের অভিষেক ম্যাচে চাতক পাখির মত ছেলের দিকে চেয়ে ছিলেন তিনি। ছেলেও কিন্তু মাকে নিরাশ করেননি, অভিষেকেই তিনি খেলেছিলেন ১২৪ বলে ৫৬ রানের ইনিংস। বল হাতেও সে টেস্টে বিহারি আলো কেড়ে নিয়েছিলেন, নিজের শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলতে নামা অ্যালিস্টার কুককে প্যাভিলিয়নে ফিরিয়েছিলেন তিনি।

বিহারির টেম্পারমেন্ট আর টেকনিক সবসময়ই ছিল উপরের কাতারে। সে সিরিজে তা নির্বাচকদের চোখও এড়ায়নি। ২০১৯ এর উইন্ডিজ সিরিজে তাই তিনি ডাক পান ভারতীয় দলে। তা নির্বাচকদের আস্থার প্রতিদান দিতেও বিহারি পিছপা হননি, এন্টিগাতেই দ্বিতীয় ইনিংসে বিহারি খেলেন ১২৮ বলে ৯৩ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। তবে, স্যাবাইনা পার্কেই তিনি ছাড়িয়ে যান আগের টেস্টকে, পেয়ে যান নিজের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি।

নিজের ছোট এই ক্যারিয়ারে এখনই ভারতীয় টেস্ট দলে আস্থার নাম হয়ে উঠছেন হনুমা বিহারি। আর এই হয়ে ওঠার পেছনে নিজের পরিশ্রমের সাথে বিহারির সাথে ছিল একজোড়া সাহসী চোখ, দুর্দান্ত হৃদয় আর বিজয়লক্ষ্মী মত একজন স্বপ্নবাজ সাহসী মা। এই মা অবাক হন না ছেলের সাফল্যে, কতটা ঘাত-প্রতিঘাতে কী ভীষণ শক্ত করে নিজের ছেলেকে বড় করেছেন তিনি।

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link