২০০৯ সালে সেই কাণ্ডের পর কী আর কখনো ইতালি গিয়েছিলেন, ডিয়েগো?
সম্ভবত না। যাওয়ার কথা নয়। ইতালিতে তাঁর জীবনের সেরা স্মৃতিগুলোর কিছু পড়ে আছে। এই ইতালিতে তিনি সাধারণ একজন থেকে মহানায়ক হয়ে উঠেছিলেন। তারপরও ইতালিয়ান কর কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের জ্বালায় সেখানে বেড়াতে যেতে পারতেন না ডিয়েগো ম্যারাডোনা। যেতে চাইতেনও না।
তবে ২০১৪ সালের আগে একবার যাওয়া বড় উচিত ছিল। আরও ভালো করে বললে বলা যায়, ২০১০ সালে আপনি যখন, দল গঠন করছেন – তার আগে অন্তত একবার এই দেশটি ঘুরে আসা উচিত ছিল। না, এখানে আপনার সাবেক জামাতা সার্জিও অ্যাগুয়েরো ছিলেন না। এখানে আপনার বরপূত্র মেসি ছিলেন না। এখানে এমনকি আঁধার থেকে টেনে আনা ভেরনেরও বসবাস ছিলো না।
তারপরও যাওয়া উচিৎ ছিল। কারণ, এখানে গেলেই আপনি দেখা পেতেন আরেজন ‘সর্বকালের সেরা’ আর্জেন্টাইনকে। বিশ্বাস করুন, তিনিও আপনার মত সর্বকালের সেরা একজন। তিনি সর্বকালের সেরা আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার হ্যাভিয়ের জানেত্তি।
একবার মিলান শহরের রাস্তায় হাঁটলে, শহরের একটা ভবঘুরেকে জিজ্ঞেস করলেও ম্যারাডোনা বুঝতে পারতেন যে, কী ভুল জীবনে করেছেন। আর্জেন্টিনার ইতিহাসে তো বটেই, পৃথিবীর অন্যতম শ্রদ্ধেয় ও যোগ্য ফুটবলারটিকে অবহেলা করেছিলেন এই ডিয়েগো ম্যারাডোনা। ইন্টার মিলানকে ট্রেবল জিতিয়ে চূড়ান্ত ফর্মে যখন মানুষটা, তখনই তাঁকে জাতীয় দল থেকে বাদ দিয়েছিলেন। এই ভুল পৃথিবীর ফুটবল ভুলবে না। আর ভুলবে না গ্রেট ফুটবলার জানেত্তিকেও।
শুধু ফুটবলার বললে বোঝা যাবে না। বলতে হবে এল কাপিতানো, হ্যাভিয়ের জানেত্তি।
শুধু রেকর্ড পরিসংখ্যান আর ইতিহাসে চোখ বুলালেই বোঝা যায় যে, কেন হ্যাভিয়ের জানেত্তিকে সর্বকালের সেরাদের কাতারে রাখেন ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। আর্জেন্টিনায় শেষ বছর দশেক ধরে এক ধরনের উপেক্ষার শিকার হলেও এই জাতীয় দলের হয়েই সর্বোচ্চ ১৪৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার রেকর্ড তার।
আর ২০১৪ সালে জুভেন্টাসের হয়ে শেষ যখন মাঠে নামলেন, সেটা ছিল তার ৬১৫তম ম্যাচ। ১৯৯৪ সাল থেকে ইতালির এই ভুবনখ্যাত ক্লাবটির হয়ে খেলেছেন। ১৯৯৯ সাল থেকে, মানে প্রায় ১৫ বছর ধরে এই ক্লাবের অধিনায়কত্ব করেছেন। এল কাপিতানো হতে আর কী চাই!
তবে, এসব ম্যাড়মেড়ে পরিসংখ্যান আর ইতিহাস দিয়ে তো আর জানেত্তিকে বোঝা যাবে না। সেটা বুঝতে গেলে তাকে মাঠে ও মাঠের বাইরে দেখতে হবে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবদন্তি রায়ান গিগস যেমন বলছিলেন, ‘আমি হ্যাভিয়েরের বিপক্ষে মাত্র তিনটি ম্যাচ খেলেছি। তাতেই আমার মনে হয়েছে, আমার ক্যারিয়ারে পাওয়া সবচেয়ে শক্ত ডিফেন্ডার সে। তবে আসল ব্যাপার হল, মাঠের বাইরে আপনি এত নম্র ও বিনীত মানুষ খুব একটা খুঁজে পাবেন না। সে একজন সত্যিকারের হিরো।’
এমনিতেই ডিফেন্সে খেলে ‘হিরো’ হওয়াটা খুব কঠিন, তার চেয়েও কঠিন ডিফেন্ডারদের এই ভদ্র ও শ্রদ্ধেয় ভাবমূর্তিটা ধরে রাখা। সবচেয়ে কঠিন বুঝি আর্জেন্টিনা থেকে একজন ‘ভালো ডিফেন্ডার’ হিসেবে বেরিয়ে আসা। অবশ্য প্রথম জীবনে জানেত্তি ঠিক ডিফেন্ডার ছিলেন না।
ছিলেন মাঝ মাঠের খেলা তৈরি করা খেলোয়াড়। হয়তো আরো একজন ম্যারাডোনাই হতেন। কিন্তু হঠাৎ করেই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড থেকে একদম সেন্ট্রাল ডিফেন্সে চলে যান জানেত্তি। ফলে পৃথিবী পায় আর্জেন্টিনা থেকে আসার বিরল এক আন্তর্জাতিক মানের ডিফেন্ডার।
জীবনের গল্পটা তার বেশিরভাগ লাতিন ফুটবলারের মতো। ইতালিয়ান বাবা-মায়ের সন্তান হিসেবে জন্মেছিলেন বুয়েনস আয়ারসের দরিদ্র এক পরিবারে। বাবা ইট কারখানার মিস্ত্রি ছিলেন। ফলে সংসারে হাত লাগাতে সেই ছোট বেলাতেই বাড়ি বাড়ি দুধ বিক্রির মতো কাজ করতে হত জানেত্তিকে।
তবে স্বপ্নটা ছিল ফুটবল। সেই স্বপ্ন নিয়ে ইন্দিপেন্দেতে ক্লাবে নাম লেখাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু আর্জেন্টিনা যুগে যুগে এই লোকটিকে চিনতে ভুল করবে বলেই যেন ঠিক করে রেখেছিল। তাই ইন্দিপেন্দেতে ফিরিয়ে দিয়েছিল জানেত্তিকে। তিনি যোগ দিলেন দ্বিতীয় বিভাগ দল তালেরেসে। পরের বছর চলে গেলেন বানফিল্ডে।
এই বানফিল্ডে জানেত্তির এক মৌসুমের পারফরম্যান্সের প্রভাব আর্জেন্টিনা ছাড়িয়ে ইউরোপে চলে এল। জাতীয় দলে ডাক পেলেন এবং মাসিমো মোরাতি কিনে নিলেন তাকে ইন্টারন্যাসিওনাল বা ইন্টার মিলানে। সেই গল্পের শুরু।
যদিও জাতীয় দলের হয়ে রেকর্ডসংখ্যক ম্যাচ খেলেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্যারিয়ারের সেরা সময়টায় ২০০৬ ও ২০১০ বিশ্বকাপে হোসে পেকারম্যান ও ম্যারাডোনা দলেই রাখেননি তাকে। এর মধ্যে ২০১০ বিশ্বকাপের আগে আগে অসাধারণ পারফর্ম করে ইন্টারকে ট্রেবল জেতানোয় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তারপরও ম্যারাডোনা তাকে দলে রাখেননি।
কেন? ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘ওর কৃতিত্ব তো মেসিকে আটকানো পর্যন্ত। এখানে সেটার দরকার নেই, তাই ওকেও দরকার নেই।’
এই একটা কথাই একজন মানুষকে খেপিয়ে দিতে পারে। কিন্তু জানেত্তি এই কথা শুনে হেসেছিলেন। শুধু বলেছিলেন, ‘কথা তো সত্যিও হতে পারে। তিনি কিংবদন্তী। তিনি নিশ্চয়ই বুঝেই বলেছেন। আমার এ নিয়ে আফসোস নেই। আমি টিভিতে বসে আর্জেন্টিনার খেলা দেখবো। দলকে সমর্থন দিয়েই পাশে থাকবো।’
বুঝলেন তো, কেন লোকেরা তাদের দেল পিয়েরো, মালদিনিদের কাতারে রাখে!