আটটি আসরে সেরা একজন। মোহাম্মাদ সালাউদ্দিন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের গুরু। তিনি যে সবার গুরু সে বিষয়ে তো আর নতুন করে বলার কিছু নেই। খোদ মাশরাফি বিন মর্তুজা এক অনলাইন শো-তে বলেছিলেন ‘আপনি আমাদের সবার স্যার’ মজার ছলে সত্যিটাই বলেছিলেন মাশরাফি। তাছাড়া ২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসানের অনবদ্য পারফর্মেন্সের কথাও নিশ্চয়ই ভুলে যাননি।
ব্যাট হাতে আগুল জ্বালানো দূর্দান্ত সব ইনিংসের পেছনে যে এই সালাউদ্দিনের অবদান ছিলো তাও অকপটে স্বীকার করেছেন সাকিব। বিশ্বকাপের আগে অফফর্মে ভোগা সাকিবকে নিয়ে একান্তভাবে কাজ করেছিলেন সালাউদ্দিন। তিনি হয়ত জাদু জানেন। অথবা তাঁর কাছে রয়েছে পরশ পাথর। তিনি হাত দিয়ে যা ছোঁয় তাই যেন স্বর্ণ হয়ে যায়।
এই যে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের কথাই ধরুণ। তিন তিনবার শিরোপা জেতা একমাত্র কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। এখন অবধি বিপিএলের আটটি আসর মাঠে গড়িয়েছে। সেখানে তাঁর দীক্ষায় শিরোপা নিয়েছে তাঁর শিষ্যরা। এখানে আবার আরেকটা পরিচয় ধ্রুব ছিলো এই তিন শিরোপা জয়ে। নামটা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। ২০১৫ সালে প্রথম আসরেই কুমিল্লাকে শিরোপা জিতিয়েছিলেন সালাউদ্দিন।
২০২২ এ আসরে এসে অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের মিশেলে দল গড়ে কুমিল্লাকে এনে দিলেন তৃতীয় শিরোপা। দেশিয় পারফরম করা খেলোয়াড়দের পাশাপাশি বিদেশি কোটায়ও দারুণ সব খেলোয়াড়দের নিয়ে এবারের আসরে কাজ করেছিলেন সালাউদ্দিন। বিশ্বকাপ জয়ী তারকা ক্রিকেটার মঈন আলী, সুনীল নারাইন ছাড়াও দলে ছিলো ফাফ ডু প্লেসিস এবং ক্যামেরন ডেলপোর্টদের মতো বিদেশি তারকা ক্রিকেটাররা।
এদের ছাড়াও দলে ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান, লিটন দাস ও ইমরুল কায়েসদের মতো পরিক্ষিত খেলোয়াড়রা। সেই সাথে তরুণ মাহমুদুল হাসান জয়, পারভেজ হোসেন ইমনদের মতো তরুণ ক্রিকেটাররাও ছিলেন এবারের কুমিল্লা দলে। মোটকথা ভারসম্যপূর্ণ এক দল গড়েই নিজের তৃতীয় শিরোপার লক্ষ্যে কাজ করতে শুরু করেন সালাউদ্দিন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর দল ফেভারিট তালিকায় উপরের দিকেই ছিলো টুর্নামেন্ট শুরুর আগে থেকেই।
পুরো টুর্নামেন্টে ফেভারিটের মতোই খেলেছে তাঁর দল। লিগ পর্বের ম্যাচে সালাউদ্দিনের শিষ্যরা। দশ ম্যাচে ছয়টাতে জয় তুলে নিয়ে টেবিলের দ্বিতীয় পজিশনে থেকে প্রথম কোয়ালিফায়ারে ফরচুন বরিশালের মুখোমুখি হয়েছিলো কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। তবে বরিশালের মুখোমুখি হওয়ার আগে লিগ পর্যায়ে তাঁদের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচটা হেরেছিলো কুমিল্লা।
কোচ সালাউদ্দিন হয়ত নিজেদের ভুলত্রুটি এবং প্রতিপক্ষের শক্তি-মত্তা যাচাই করতে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন কোয়ালিফায়ারের আগে। তাতে অবশ্য লাভ হয়নি হারতে হয়েছিলো তাঁর দলকে। সমীকরণ তখন ২-১। পাল্লাটা ভারি বরিশালের।
হেরে যাওয়া দুই ম্যাচেই বরিশালের বিপক্ষে রান তাড়া করতে গিয়ে হেরেছে কুমিল্লা। অন্যদিকে এক ম্যাচে আগে ব্যাটিং করে জিতেছিলো। সেই তথ্য নিয়েও হয়ত ঘেটে দেখেছেন সালাউদ্দিন। ব্যাস চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের বিপক্ষে কোয়ালিফায়ার জিতে আর ভুলের পুনরাবৃত্তি করেননি সালাউদ্দিন।
শিশির বোলিং এ ব্যাঘাত ঘটাতে পারে জেনেও প্রথমে ব্যাটিং নিয়ে নেয় কুমিল্লা। এরপর যা হয়েছে তা তো সবারই জানা। এসব খুঁটিনাটি বিষয় ছাড়াও যে সালাউদ্দিনের জহুরী চোখ তারুণ্যের মাঝে প্রতিভা খুঁজে বেড়ান সেই নজির তো আর নতুন না। তা না হলে মাত্র কয়েকটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা মাহমুদুল হাসান জয়কে নিয়ে নেটে সময় কাটানোর ভিডিও তো খোদ খেলা-৭১ নিয়ে এসেছিলো আপনাদের কাছে।
আর জয় তাঁকে হতাশ করেনি। সালাউদ্দিনের জহুরীর চোখ তো আর মিথ্যা হতেও পারে না। তাছাড়া বিদেশি বোলারদের থেকেও তিনি ভরসা রেখেছেন দেশি পেসারদের উপর। তিনি যে ভুল করেননি সেই প্রমাণ তো দিয়েই দিলেন মুস্তাফিজ আসরের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হয়ে। অন্যদিকে শোহিদুল ইসলাম শেষ ওভারে দশ রানও আটকে দিয়ে শিরোপা নিশ্চিত করালেন। সালাউদ্দিন ভুল হতে পারেন না।
অবশ্য এর আগেও বেশ কিছু দলের হয়ে বিপিএলে কাজ করেছিলেন সালাউদ্দিন। সেই সব ফ্রাঞ্চাইজিদের হয়ে খুব বেশি সফলতা পাওয়া হয়নি। ২০১৫ সালে কুমিল্লাকে শিরোপা জেতানোর পর তাঁকে আর ধরে রাখেনি কুমিল্লা। ২০১৬ আসলের ভরাডুবি কুমিল্লাকে বাধ্য করে সালাউদ্দিনকে আবার ফিরিয়ে আনতে। তারপর ২০১৭ সাল থেকে এখন অবধি হওয়া তিন আসরে দুইটিতেই শিরোপা এনে দিয়েছেন সালাউদ্দিন।
এক্ষেত্রে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় হস্তক্ষেপ না করাটা বিশাল এক ভূমিকা হতে পারে। তাছাড়া সালাউদ্দিনকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেওয়াও হয়ত হতে পারে এমন সফলতার একটি বড় কারণ। তবে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই যে সালাউদ্দিনের পরিকল্পনা এবং কৌশল এককথায় সেরা। বাংলাদেশ ক্রিকেটটাকে খুব ভাল করেই জানেন, বোঝেন।
বিপিএলের ইতিহাসের তিনি এখন পর্যন্ত সেরা। তাঁর সেই সামর্থ্যও রয়েছে সেরা হয়েই বিপিএলের ইতিহাসের নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যেখানে তাঁকে ছুঁতে পারবে না কেউ। কোচ সালাউদ্দিন এক এবং অনন্য।