প্রথম টেস্টে ভারতের লজ্জাজনক হার। তারপর অনেক তাবড় তাবড় অজি ক্রিকেটার ভবিষ্যৎবাণী বা হুমকি দিয়েছিল সিরিজ ৪-০ ভারত হারবে। প্রথম টেস্টে দুমড়ে যাওয়া একটা দল যে এভাবে ইস্পাতকঠিন মনোভাব নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে সত্যি কথা বলতে আমিও ভাবিনি। দ্বিতীয় ভারতের টেস্টে অভাবনীয় জয় অন্ধকারে রিপোলি আলোর রেখা ফুটিয়ে তুলেছিল। তারপর একে একে তারকা ক্রিকেটার চোটের কারণে বসে গেল। তৃতীয় টেস্টে প্রথম একাদশ ঢেলে সাজানো হল।
তৃতীয় টেস্টেও ভারতীয় খেলোয়াড়দের চোট রইল অব্যহত। এবারে আহত হল রবীন্দ্র জাদেজা। আরেক স্তম্ভে ফাটল ধরল। খেলা চলাকালীন ফের চোট পেল অশ্বিন, হনুমা। তবু মাটি কামড়ে পড়ে রইল রবিচন্দ্রন অশ্বিন-হনুমা বিহারি জুটি ৪২.৪ ওভার। পাঁচ উইকেট ভারতের রান ৩৩৪ শেষ হল পঞ্চম দিন। স্বরণীয় হয়ে থাকল দু’জনের মহাকাব্যিক ইনিংস। চেতেশ্বর পূজারা (৭৭) আর ঋষাভ পান্তের (৯৭) রানের উল্লেখযোগ্য অবদান। অস্ট্রেলিয়ার জয়ের স্বপ্ন কার্যত শেষ হয়ে গেল। বেলা যত গড়াচ্ছিল, ততই হতাশ ও অসহায় লাগছিল অসি পেসব্যাটারিকে।
শেষ টেস্টে চোটের কারণে ছিল না অশ্বিন-হনুমা বিহারি। প্রায় গোটা রিজার্ভ বেঞ্চকেই নামতে হল গ্যাবায়। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে ৩৬৯ এর জবাবে ভারতের ৩৩৬ বোঝাই যাচ্ছিল বিনাযুদ্ধে হেরে যেতে প্রস্তুত নয় ভারতের তরুণতুর্কিরা। উঠে এল আরেক সপ্রতিভ জুটি শার্দুল-সুন্দর। দুই তরুণের ৬৭ এবং ৬২ রানের অভাবনীয় ইনিংস। শার্দুল খেলল ১১৫ বল সুন্দর ১৪৪ বল।
দু’জনের হার-না-মানা মনোভাবে ভারতের প্রথম ইনিংস ৩৩৬ রানে শেষ হল অজিরা এগিয়ে থাকল মাত্র ৩৩ রানে। এই রানের লিড টেস্টে কিছুই নয়। খেলা তখনই ৫০-৫০ হয়েছিল। স্পষ্ট হয়ে গেছিল যে কোনো একটা দল জিতে যাবে এই টেস্ট সঙ্গে সিরিজ। সিরাজ আর শার্দুলের শাণিত বোলিং জুটির দাপটে অজিদের দ্বিতীয় ইনিংস গুটিয়ে গেল ২৯৪ রানে।
ভারতের জয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩২৮ রান। হাতে ১০০ ওভার। ওভার পিছু তিন রানের কিছু বেশি। অংকের নিয়মে ম্যাচ জেতা খুব সোজা। কিন্তু ক্রিকেটের নিয়মে বড় কঠিন। কারণ শেষ দিন, চতুর্থ ইনিংসে টিকে থাকাই যে কোনো দলের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। এই অবস্থায় ভারত বড়জোর ড্র করে সিরিজ বাঁচবে এমনটাই প্রত্যাশা করেছিল অস্ট্রেলিয়া, এমনকী আমরাও। কিন্তু দিনের শুরুতেই গিলের ১৪৬ বলে ৯১ রানের ঝকঝকে ইনিংসটা জয়ের হাতছানি দিচ্ছিল।
গিল আউট হতে সে হাতছানি মিলিয়ে গেছিল। পূজারা দায়িত্ব নিয়ে পরিণত ব্যাটিং করে যাচ্ছিল। বুকে হাতে মাথায় বাউন্সার লাগল। তবু নাছোড় দীর্ঘ ইনিংস শেষ হল ৫৬ রানে। ২১১ বল মানে ৩৫ ওভার ব্যাট করে গেল পূজারা। জিততে গেলে উইকেটে টিকে থাকা ভিষণ দরকার ছিল। তারপর জিততে গেলে প্রয়োজনীয় রানরেটকে হাতের মুঠোয় কীভাবে এনে ফেলতে হয় সেটা দেখাল পন্থ। সময়ে সময়ে ঝলসে উঠল তার ব্যাট। সঙ্গে সুন্দরের যোগ্য সঙ্গত।
বড় হিটের প্রত্যাশী না হয়ে একরান, দু’রানের দিকে ঝুঁকেছিল দু’ ব্যাটসম্যানই। সুযোগ মতো আসছিল চার ছয়। একটা সময় জয়ের রানরেট এসে দাঁড়াল পাঁচে। তখন হাতে ৫ উইকেট। হাত সেট হয়ে গেছে পান্ত-সুন্দরের। জয় ছাড়া কোনোভাবেই আর ড্র-য়ের কথাও ভাবা যাচ্ছিল না। শরীর গরম হয়ে যাচ্ছিল, বুকে যেন হাতুড়ির বাড়ি পড়ছিল। ওয়ান ডে বা টি-টোয়েন্টির মতোই উত্তেজক হয়ে গেছিল এই টেস্ট। খুব কমই এমনটা হয়।
৪ ওভারে জেতার জন্য দরকার ১০ রান। মনে হচ্ছিল জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। পাশাপাশি মনে হচ্ছিল রূপকথার গল্প দেখছি! এও কি সম্ভব! যে মাঠে ৩২ বছর হারেনি অস্ট্রেলিয়া সেই মাঠে এভাবে হেরে যাবে! ভাবতে ভাবতে হ্যাজেলউডের বলে এল কাঙ্খিত চার। স্বপ্ন ক্রমশ সত্যি হতে চলেছে। ইতিহাস লিখতে দরকার আর মাত্র ৪ রান।
৯৬ তম ওভারের শেষ বল পন্থের ব্যাট থেকে বল চলে যাচ্ছিল বাউন্ডারি লাইনের দিকে। তিন রান পুরো করতে মরিয়া পান্ত আর সাইনি। বাউন্ডারির দু’ধারে কোনো অজি ফিল্ডারের নাম ও নিশান নেই! বল বাউন্ডারির সীমানা ছুঁলেই লেখা হবে নব তরুণোদয়ের ইতিহাস – দুর্ঘটনা অস্ট্রেলিয়ায়।