সাল ১৯২২, এসসিজিতে নিউ সাউথ ওয়েলসের দুইটি একাদশ মুখোমুখি হয়েছে চার্লস ব্যানারম্যানের সম্মানে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলতে। ব্রিটিশ ভদ্রলোকের নাম লেন ওয়াট, সাবেক ক্রিকেটার ছিলেন এককালে, মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে ভরাট গলায় বলে উঠলেন, ‘গো অন টকিং!’
ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ধারাভাষ্য দেওয়ার শুরুটা হয়ে যায় এই কথাটার মধ্য দিয়েই। তবে এই ম্যাচের সরাসরি ধারাভাষ্য আর্ন্তজাতিকভাবে প্রচার করা সম্ভব হয়নি, এ ম্যাচের ধারাভাষ্য সিডনির স্থানীয় স্টেশনে প্রচার করা হয়েছিল, সেদিন ওয়াট করেছিলেন সংক্ষিপ্ত ধারাভাষ্য, অর্থাৎ উইকেট পতন কিংবা বাউন্ডারির বর্ণনা দিচ্ছিলেন।
এক বছর পর ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে এই এসসিজিতেই ধারাভাষ্যকার প্রথম বল বাই বল বর্ণনা করেছিলেন, ধারাভাষ্য দিয়েছিলেন লেন ওয়াটই। ১৯২৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার সরকারি রেডিওতে ক্রিকেট কমেন্ট্রি শুরু হয়, তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রীকে সৌজন্য দেখিয়ে সে ম্যাচে ধারাভাষ্যের উদ্বোধন করার জন্য আহবান করা হয়েছিল।
১৯২৭ সালের দিকে বিবিসি ক্রিকেট ধারাভাষ্যের দিকে আগ্রহী হয়, যখন একই বছরের শুরুতে টেডি ওয়ালকমের দেয়া ইংল্যান্ড বনাম ওয়ালসের মধ্যকার রাগবি ম্যাচের ধারাভাষ্য মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পায়। এটিই ছিল বিবিসির প্রথম স্পোর্টস কমেন্ট্রি প্রজেক্ট।
সেই বছরই লেয়টনে এসেক্স বনাম নিউজিল্যান্ড ম্যাচ দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটেনে রেডিওতে ক্রিকেট কমেন্ট্রি দেয়া শুরু হয়। সেই ম্যাচের কমেন্ট্রি দিয়েছিলেন প্লাম ওয়ার্নার, যিনি ইংল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার ছিলেন। তবে পরবর্তীতে তাকে রিপ্লেস করে এফ. এইচ. গিলিংহামকে কমেন্ট্রিতে নিয়োগ দেয় বিবিসি।
তবে ক্রিকেট ধারাভাষ্যের প্রচন্ড জনপ্রিয়তা শুরু হয় ১৯৩০ সালে, যখন বিবিসি অ্যাশেজ কভার করে। তখনকার জরিপ জানিয়েছিল, এ ম্যাচগুলি কভারের ফলে বিবিসির জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে যায় যে, অধিক ট্রান্সমিশনের ফলে বাজারে ক্যাবলের দাম বেড়ে যায়।
১৯৩২ সালে বিবিসি ফ্রান্সে আরেকটি স্টেশন স্থাপন করে, ফলে দুইটি স্টুডিও থেকে ইংল্যান্ডে খেলা সম্প্রচার হচ্ছিল। আইফেল টাওয়ারের একটি স্টুডিও থেকে সাবেক ক্রিকেটার অ্যালেন ফেয়ারফ্যাক্স ধারাভাষ্য দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ফ্রান্সে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি।
১৯৩৪ সালে প্রথমবারের মতো বিবিসি প্রতি টেস্টের বিস্তারিত বিবরণ (Match Summary) দিচ্ছিল। এবং এনালাইসিসের জন্য এক্সপার্টদের নিয়োগ দিয়েছিল। ১৯৩৭ সালে আরো একটি দারুণ কাজ করে বিবিসি। মহিলা ক্রিকেটে ধারাভাষ্য শুরু হয় সে বছর। প্রথম নারী ধারাভাষ্যকার মার্গারি পোলার্ড ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার ওভাল টেস্টে হটসিটে বসে নারী ধারাভাষ্যের উদ্বোধন করেন।
১৯৩৮ সালে বিবিসির প্রথম শর্টওয়েভ সরাসরি অস্ট্রেলিয়ায় সম্প্রচারিত হয়, যদিও প্রথমদিকে মান ছিল খুবই নিম্ন এবং ঘন ঘন কেটে যাচ্ছিল। সেই বছরই বিবিসি একটি স্কোরার নিয়োগ করে – আর্থার র্যাগলি নামের সেই পরিসংখ্যানবিদ নিয়মিত স্কোর আপডেট দিতে থাকেন, এবং বিভিন্ন স্টেটস দিয়ে ধারাভাষ্যকারদের সাহায্য করেন।
১৯৩৮ সালে লর্ডস টেস্ট দিয়ে প্রথম টিভি সম্প্রচার সম্ভব হয়। যদিও বিবিসি আগেই পরীক্ষামূলক সম্প্রচার করে ওভাল টেস্টে, যে ম্যাচে লেন হুইটন ৩৬৪রানের রেকর্ড গড়া ইনিংসটি খেলেন।
১৯৩৮ সালে বিবিসি প্রথমবারের মতো বিদেশে সফলভাবে ব্রডকাস্ট করতে সক্ষম হয়। জিম সুইটেন দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইংল্যান্ডের মধ্যকার জোহানেসবার্গ টেস্টে ধারাভাষ্য করেছিলেন। দ্বিতীয় দিনে, বক্সিং ডেতে – টম গডার্ড যখন একটি হ্যাটট্রিক করেন তখন সুইটেন এয়ারেই ছিলেন। ম্যাচটি সম্প্রচারিত হয় দক্ষিণ আফ্রিকাতেও।
১৯৩৯সালে ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরও সফলভাবে ক্যারিবীয় অঞ্চলে সম্প্রচার করে বিবিসি। ১৯৩৯-৪৫পর্যন্ত বিশ্বযুদ্ধের কারণে টিভি সম্প্রচার বন্ধ থাকলেও রেডিওতে প্রতিবেদন দেয়া অব্যাহত রাখে বিবিসি।
১৯৪৬ সালে, যুদ্ধপরবর্তী সময়ে, কমেন্ট্রিকে আরো আধুনিকীকরণ ও প্রাঞ্জল করতে কাজ করে বিবিসি। তাঁরা কিছু স্ট্রাটেজি আমূল পাল্টে ফেল। জন আর্লট, রেক্স অ্যালস্টনের মত লিজেন্ড ধারাভাষ্যকাররা বিবিসিতে যোগ দিতে থাকেন।
পুরোনো সৈনিক সুইটেনকে নিয়ে ইংল্যান্ডের ভারত সফরে অসাধারণ কমেন্ট্রি করেন। এবং সেবারই প্রথম আব্দুল হামিদ শেখ নামের ধারাভাষ্যকার হিন্দীতে ধারাভাষ্য দেন, যা ভারতে প্রচারিত হয় একই চ্যানেলে। ফলে ভারতবাসী ইংরেজির পাশাপাশি মাতৃভাষাতেও ধারাভাষ্য শোনার সুবিধা পায়।
১৯৪৮ সালের আগে ইংল্যান্ডের ম্যাচে ইংরেজরাই ধারাভাষ্য দিতো, তবে সে বছর, অস্ট্রেলিয়ান আলেক ম্যাকগিলভ্রে ‘গেস্ট কমেন্টেটর’ হিসেবে বিবিসি টিমে যোগ দেন অ্যাশেজ কভারের জন্য।
টিভি কভারেজ এখন খুবই সহজ একটি ব্যাপার হলেও তখন তা ছিল না। ব্রায়ান জনস্টন এবং এডেন ক্রাউলিরা টিভিতে কমেন্ট্রি দিলেও তা লর্ড ও ওভালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৫০ সালে এজবাস্টন, ওল্ড ট্র্যাফোর্ডকে, এবং হেডিংলিকে ১৯৫২সালে টিভি কভারেজের আওতায় আনা হয়।
১৯৫৭ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিকের জন্য অস্ট্রেলিয়াতে টিভি স্পোর্টস কভারেজ শুরু হয়, এবং বিবিসি সেই সুযোগে ক্রিকেট ব্রডকাস্ট করতে শুরু করে।
১৯৫৭ সালে বিবিসি রেডিওতে একটি প্রযুক্তির সাহায্যে প্রথমবারের মত অবিচ্ছিন্ন বল বাই বল কভারেজ দিতে সক্ষম হয়। বর্তমানে রেডিও কমেন্ট্রিতে সেই টেকনোলজিরই থার্ড জেনারেশন ফরম্যাট ব্যবহৃত হয়।
১৯৬৮সালে প্রথমবারের মত রঙিন টিভিতে খেলা সম্প্রচার করে বিবিসি। ১৯৭১ সালে প্রথমবারের জন্য প্রতিদিনের খেলার সম্প্রচারের হাইলাইট দেখানোর প্রচলন শুরু করে বিবিসি।
১৯৭৭ সালে ক্যারি প্যাকার এবং এসিবির মধ্যে ব্রডকাস্ট অধিকারগুলি নিয়ে তিক্ততা সৃষ্টি হয়। অনেক যুদ্ধের পর প্যাকার অবশেষে ম্যাচ অভারের রাইটস পান এবং ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটকে নিয়ে একটি বিপ্লব ঘটান। সাদা বল, রঙিন জার্সি, ডেনাইট ম্যাচ শুরু হয় তখন থেকে। স্কাই স্পোর্টস একের পর এক দারুণ ক্রিকেটরিলেটেড শো দেখাতে থাকে।
১৯৯০ সালে স্কাই স্পোর্টস প্রথমবারের মত একটি ওভারসিস সিরিজ কভারের অনুমতি পায়। এর আগে, বিবিসি বিদেশে কেবল অ্যাশেজ নিয়মিত কভার দিতো, অন্যগুলো দিত মাঝেমাঝে। কিন্তু স্কাই স্পোর্টস ইংল্যান্ডের বেশিরভাগ সফর ব্রডকাস্ট করতে থাকে।
১৯৯৯ সালে ৬১ বছর পর, বিবিসি টিভিস্বত্ত্ব পুরোপুরিভাবে ত্যাগ করে, ইংল্যান্ডে টেস্ট ক্রিকেটের একচেটিয়া অধিকার হাতে চলে আসে স্কাই স্পোর্টস ও চ্যানেল ৪ এর। ২০০৫ সালে চ্যানেল ৪ স্বত্ব স্কাই স্পোর্টসের কাছে বিক্রি করে দেয়। এবং স্কাই স্পোর্টস ইংল্যান্ডের সবধরণের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট ম্যাচ কাভারের রাইটস পেয়ে যায়। স্কাই স্পোর্টস থেকে দীর্ঘদিন অন্যান্য টিভি চ্যানেল স্বত্ব ভাড়া নিয়ে টেলিকাস্ট করতো।