‘বাংলাদেশি’ এলিটা কিংসলেকে ঘিরে আশা

বাংলাদেশের খেলাধুলার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিদেশি একজনের ‘বাংলাদেশি’ হওয়ার রেকর্ড গড়েছেন এলিটা কিংসেলে। বসুন্ধরা কিংসের হয়ে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটির বিপক্ষে খেলার মাধ্যমে নতুন দিগন্তে পা রেখেছে ফুটবল। একজন বিদেশি খেলোয়াড়ের ‘বাংলাদেশি’ নাগরিকত্ব নিয়ে খেলার ঘটনা এটাই প্রথম।

এর আগে খেলাধুলায় মাত্র দুজন বিদেশিকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল। প্রথমজন বক্সিংয়ের কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলী, দ্বিতীয়জন ক্রিকেটের গর্ডন গ্রিনিজ। গর্ডনকে নাগরিকত্ব দেবার মূল কারণ ছিল বাংলাদেশকে আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন করিয়ে বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়া। আর এবার পুরোপুরি ভিন্ন কারণে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন এলিটা কিংসেলে।

নিজ দেশ নাইজেরিয়ার নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন মূলত বাংলাদেশি মেয়ে লিজাকে বিয়ে করার কারণে। পাশাপাশি নিজের দেশে ফুটবলে জাতীয় দলে খেলার আশা না থাকাটাও একটা বড় কারণ। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশের জাতীয় দলে যারা ষ্ট্রাইকার হিসেবে খেলছেন আন্তর্জাতিক ম্যাচে তাদের ব্যর্থতাও যোগ হয়েছে তাতে।
মূলত বছর চারেক আগে ঢাকার মাঠে খেলা বয়সে কম বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়দের নাগরিকত্ব দেবার একটা উদ্যোগ গ্রহন করেছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) জাতীয় দল ব্যবস্থাপনা কমিটি।

কিন্তু, সর্বমহল থেকে এ নিয়ে ব্যপক প্রতিবাদের মুখে পড়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই সেই পরিকল্পনা থেকে পিছু হটে বাফুফে। কিন্তু জাতীয় দলে দক্ষ গোলস্কোরারের অভাব এরপরও পূরণ হয়নি। বাংলাদেশকে ভালবেসে এদেেেশর নাগরিকত্ব নেওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, লাল সবুজ জার্সি গায়ে খেলা। এলিটাকে এখনো অকেটা পথ পাড়ি দিতে হবে।

যেমন করে ‘বাংলাদেশি’ হতে গিয়ে তাকে বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছে। নাইজেরিয়ান হিসেবে খেলবেন বলে গত ১৬ মাস ছিলেন না প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে। শুরুতে নিজ দেশের নাগরিকত্ব বাতিল চেয়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর চলতি বছরের মার্চে হাতে পান বাংলাদেশি পাটপোর্ট। একটা ধাপ পেরিয়ে এরপর অপেক্ষায় থাকেন জাতীয় পরিচয়পত্রের।

কারণ ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে প্রমাণের জন্য পাসপোর্টের পাশাপাশি এনআইডি কার্ডও লাগবে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে আবার সেটি পেতে বিলম্ব হচ্ছিল। একাধিকবার লকডাউনের কারণে অফিসই বন্ধ ছিল। এদিকে আবার এএফসি (এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন) কাপের সময় চলে আসে। অন্যদিকে অপেক্ষা বাড়তে থাকে এলিটার। তারিখ নির্ধারনের পর অনেক নাটকীয়তা শেষে মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত আসর স্থগিত হয়ে যায়।

এনআইডি হাতে না পাওয়ায় স্থস্তির নি:শ্বাস পেলেন তিনি। এরপর আবার এলিটার ক্লাব বসুন্ধরা কিংস এএফসি কাপ পেছানোর আবেদন করে। এশিয়ার ফুটবল অভিবাবকরা আবেদনে সাড়া দিয়ে আসরটি পিছিয়ে আগষ্ট মাসে নিয়ে যায়। এরপর চলতি জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে এলিটার হাতে চলে আসে কাঙ্খিত এনআইডি কার্ড। যখণ ২৫ জুন থেকে আবারো শুরুর অপেক্ষায় ছিল প্রিমিয়ার লিগ ফুটবল, তখন জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে নিয়ে যেন বুক থেকে বড়সড় একটা পাথরই নেমে গেল এলিটা কিংসেলের।

একদিন পিছিয়ে ২৬ জুন শুরু হয় বিপিএলের খেলা। প্রথমদিনই টেবিল টপার বসুন্ধরা নামে রহমতগঞ্জের বিপক্ষে। আগে থেকেই দলটির কোচ অস্কার ব্রুজোন জানিয়ে দেন এলিটাকে প্রথম একাদশে রাখার বিষয়টি। ২০ নাম্বার জার্সি পড়ে মাঠে নামার পরই তৈরি হয় নতুন ইতিহাস। বাফুফের পক্ষ থেকে সংবাদকর্মীদের হাতে যে খেলোয়াড় তালিকা দেওয়া হয় তাতে এলিটা খেলন একজন বাংলাদেশি হিসেবে।

শুরুতে মাঠে তার দৌড়ানো দেখে একটা বিষয় পরিস্কার হয়ে যায়, দীর্ঘ সময় প্রতিযোগিতামুলক ফুটবল না খেলার কারণে ফিটনেসে অনেকটা ঘাটতি রয়েছে। নিজে চেষ্টা করেছিলেন বাংলাদেশি হিসেবে প্রমানের। কয়েকটা সুযোগ হাতছাড়া করার পর ২৯ মিনিটে ব্রাজিলিয়ান সতীর্থ জনাথনের ক্রস থেকে হেডে গোল করে বুনো উল্লাসে মেতে ওঠেন এলিটা। সাথে যোগ দেন দেশি-বিদেশি খেলোয়াড়রা। কোচের আস্থার প্রতিদান দিয়ে যেন উপর ওয়ালাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। এই ম্যাচের পর বাংলাদেশি হিসেবে লিগ শেষে নিজের নামের পাশে ১০টি গোল দেখতে চান তিনি।

যুদ্ধজয়ের পর এখন নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন ৩১ বছর বয়সী এলিটা কিংসেলে, ‘অনেক কষ্ট করে আমাকে বাংলাদেশী হয়ে বসুন্ধরা কিংসের জার্সি পড়ে নামতে হয়েছে। ক্লাব সভাপতি, কোচ, সতীর্থদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আর প্রথম ম্যাচেই গোল করতে পেরে দারুণ খুশি হয়েছি। যদিও ঢাকার মাঠে এমন গোল অনেক করেছি। লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিল টিম বিজেএমসির হয়ে। এখন জাতীয় দলের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করাই আমার লক্ষ্য।’

এলিটার ‘বাংলাদেশি’ হওয়ার বেশি খুশি হয়েছেন জাতীয় দলের প্রধান কোচ জেমি ডে। তবে এখনই জাতীয় দলের জন্য বিবেচনায় আনতে চান না তাকে। লিগে নিজেকে প্রমাণ করে তবেই তার নজর কাড়তে হবে। জেমি ডে পরিস্কার করে বলেছেন, ‘কিংসেলে প্রথম ম্যাচেই গোল পাওয়ায় আমি খুশি হয়েছিল। এখন তাকে ফিট থাকার পাশাপাশি প্রতিটা ম্যাচে পারফর্ম করে তবেই জাতীয় দলের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে।’ একজনকে দিয়ে জাতীয় দলের চেহারা বদলানো যাবেনা। ভবিষ্যতের জন্য বড় পরিকল্পনাই পারে গোল স্কোরারের অভাব পূরণ করতে।

এদিকে এলিটার ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে অভিষেকের দিনে মাঠে বসে দেখেছেন জাতীয় দলের সহকারী কোচ ষ্টুয়ার্ট ওয়াটকিস। ২০২০ সালের মার্চে সর্বশেষ আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের জার্সি গায়ে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। প্রায় দেড় বছর পর মাঠে নামা এলিটার খেলা দেখে ওয়াটকিসের মূল্যায়ন, ‘এলিটা দীর্ঘািদন পর মাঠে নেমেছে। তার খেলায় আমি খুশি হয়েছি। তাকে নিয়ে বসুন্ধরার শক্তিও বেড়েছে। স্থানীয় খেলোয়াড় হিসেবে বসুন্ধরা ও বাংলাদেশের জন্য এলিটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সামনেই এশিয়ান কাপের বাছাইপর্ব ছাড়া ফিফার তিনটা উইন্ডোতে খেলা হয়েছে। তার খেলায় আমি আশাবাদী।’

তবে ফুটবল বিশ্লেষকদের ধারণা, ৩১ বছর বয়সী এলিটা কিংসেলে নিয়ে বড় পরিকল্পনা করতে পারবেনা বাফুফে। আরও কম বয়সী খেলোয়াড়দের খুজে বের করতে হবে। তাকে দিয়ে খণ্ডকালীন সমস্যার সমাধান হলেও ভবিষ্যতের জন্য আরো ভাল খেলোয়াড় প্রয়োজন জাতীয় দলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link