বিপ্লব-বয়কটে লেগে থাক আফ্রিকান গোলাপের সৌরভ

১.

বিশ্বকাপ ফুটবলের মধ্যে সর্বদেশীয় টুর্নামেন্ট বোধহয় আর পৃথিবীতে নেই। দেড়শোর বেশি দেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আসে, তার মধ্যে শিকে ছেঁড়ে মোটে ৩২ টা দেশের। বিশাল প্রতিযোগিতার মধ্যে চলতে হয় চার বছর ধরে, আর সেটাকে সঙ্গ দেয় ক্লাব ফুটবল। সে যাক গে।

কিন্তু তাতে একফোঁটাও বিতর্ক থাকবে না, তা হয়? শুধু জনগণের চোখে দেবতা হয়ে বেঁচে থাকার জন্য বেনিটো মুসোলিনি ১৯৩৮-এর বিশ্বকাপের ‘দায়িত্ব’ নিজ হস্তে তুলে নেন। সেটা নিয়ে আবার তৎকালীন ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমে বলেন, ‘ওই বিশ্বকাপে আমি আয়োজক ছিলামই না!’

তেমনই অষ্টম বিশ্বকাপের আয়োজক ছিল রাজার দেশ ইংল্যান্ড। সেবার বিশ্বকাপও জিতেছিল তারা। কিন্তু সঠিক পন্থায় নয়, সঠিক নিয়ম অনুযায়ী নয়। অস্যার্থের পরাকাষ্ঠা হয়েই আজন্ম বেঁচেবর্তে রইল। ১৯৬৬-র বিশ্বকাপ তাই অনেক বিতর্কের আঁতুড়ঘর। যার শুরুটা হয়েছিল খুবই ন্যক্কারজনক ভাবে।

২.

ছয় মার্চ, ১৯৫৭। ঘানা সেদিন উচ্ছ্বাসে-উল্লাসে মাতোয়ারা। সদ্য ব্রিটিশ কলোনিয়াল রুল থেকে তারা অর্জন করেছে স্বাধীনতা। নব নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট কেওয়ামে এনক্রুমা ঘোষণা করলেন, ফুটবলই হবে সমগ্র আফ্রিকার মিলন প্রাঙ্গণ। সেই প্রথম, ফিফার কার্যনির্বাহি কমিটিতে জায়গা পেল আফ্রিকার প্রতিনিধিরা। যাদের একজন ওহেনে জজান, যিনি তৎকালীন ঘানার স্পোর্টস ডিরেক্টরও বটে। ফিফা কমিটিতে তিনি আবার শুধু একা নন, পাশে পেলেন এক ইথিওপিয়ানকে – টেসেমা এডনেকাচ্যু।

এই দুই ভদ্রলোকের সৌজন্যে সমগ্র আফ্রিকায় ফুটবলের পরিবেশ পাল্টাতে লাগল ধীরে ধীরে। চাদ, সোমালিয়া, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিকে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর এনে জায়গায় জায়গায় লোক পাঠিয়ে ট্যালেন্ট খুঁজে আনা হতে লাগল। আস্তে আস্তে আফ্রিকার ফুটবলে চুপিসাড়ে ঘটে যেতে লাগল নবজাগরণ। কেউ টের পেল না। আর তাই ১৯৫৭ থেকে আফ্রিকার হয়ে ফিফার দরবারে দরখাস্ত দিতে শুরু করলেন এই দুই সৈনিক।

যারা প্রচার করতে লাগলেন, আফ্রিকার ফুটবলের সার্বিক উন্নতি এখন চোখে পড়ার মতো। বাস্তবিকই তাই ছিল। কারণ এরপর ১৯৬৩, ১৯৬৫ – পরপর দু’বছর ঘানা জিতে নিল ‘ব্ল্যাক স্টার’। উঠে এলেন এক তরতাজা তরুণ উইংগার, ওসেই কোফি। আর তারপর এল ১৯৬৪ সাল।

১৯৬৪-তে তৎকালীন ফিফা প্রেসিডেন্ট স্ট্যানলি রস (১৯৬১-১৯৭৪) একটা রুল ঠিক করলেন। ১৬টা দল, তাতে ১০টা (৯+১) আসবে ইওরোপ থেকে। বাকিদের মধ্যে চারটে লাতিন আমেরিকা থেকে, একটা সেন্ট্রাল আমেরিকা আর আরেকটা – ওশিয়ানিয়া, এশিয়া আর আফ্রিকা থেকে!

বলা বাহুল্য, ফিফা কমিটিতে ঝড় বয়ে গেল। টেসেমা, এনক্রুমা তীব্র বিরোধিতা করলেন। ঘটনাটার কড়া ভাষায় নিন্দা করে টেলিগ্রাম করলেন জুরিখে, ফিফার সদর দপ্তরে। টেসেমা তো সর্বসমক্ষে বলেই ফেললেন, ‘এই বিশ্বকাপ হতে চলেছে পুরোপুরি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং ভৌগলিকভাবে সবচেয়ে উপহাসের বিশ্বকাপ।’

ফিফার এক্সিকিউটিভ কমিটিতে বসে কেঁদে ফেললেন ঘানার স্পোর্টস ডিরেক্টর জজান। চিঠি দেওয়া হল। জজান নিজে আফ্রিকান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনে (ক্যাফ) ছিলেন, এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় মর্মাহত হয়ে পড়লেন, ‘Afro-Asian countries struggling through painful expensive qualifying series for ultimate one finalist representation is pathetic and unsound at the worst. Africa should have one finalist, urgent, reconsider…’

তিনটে যে যে যুক্তি ক্যাফ থেকে দেওয়া হয়েছিল ফিফাকে, তিনটেই ঠিক যুক্তি।

  • আফ্রিকার ফুটবলের মান আগের তুলনায় অনেক, অনেক বেশি বেড়েছে (ফিফা কানেও তোলেনি)।
  • আফ্রিকার শীর্ষ দলের সাথে ছোট আর নিচের দিকে থাকা টিমগুলোর মধ্যে প্লে-অফের ব্যবস্থা করা অনেক বেশি খরচসাপেক্ষ।
  • বর্ণবাদী মনোভাবসম্পন্ন ফিফা আফ্রিকার ফুটবলকে বলি করছে – ঠিক নয় এটা। দিস ইস আনফেয়ার!

কিন্তু সব অনুযোগ-অভিযোগ, বিনয় সত্বেও ফিফা কারোর কথায় কোনওরকম কর্ণপাতই করেনি। খেলার ফরম্যাটও পরিবর্তিত হয়নি, চিঠির উত্তরে বরফ বিশেষ গলেওনি। আর তাই, ইতিহাসে প্রথমবার, এবং সম্ভবত শেষবার কোনও মহাদেশ একজোট হয়ে ফুটবল বিশ্বকাপকে বুড়ো আঙুল দেখাল। খেলল না, বয়কট করল। ১৬ টা দলের একটা দলও আফ্রিকা থেকে পেল না ফিফা।

সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ভাবে বলির পাঁঠা করা হল ঘানাকে, কারণ তখন ফিফা প্রেসিডেন্ট একজন ব্রিটিশ এবং ঘানা সদ্য স্বাধীনতা পেয়েই যুক্ত হয়েছিল ফিফার দপ্তরে। যেটা মোটেই ভাল চোখে নেননি রস সাহেব। কিন্তু ১৯৭০-এ এসে গল্প পাল্টে যায়। মরক্কো প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে বিশ্বকাপে অংশ নেয়।

কিন্তু আফ্রিকাকে ভুগতে হয়েছিল এর পরেও। যখন ১৯৮২-তে স্পেনে গিওনের মাঠে ঘটল ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়। ডিসগ্রেস অফ গিওন!

৩.

ওসেই কোফিকে তুলনা করা হতো জর্জ বেস্টের সাথে। ক্রমাগত টাচলাইনের ধারে ওঠানামা থেকে গেমমেকিং – একজন তুখোড় উইংগারের সব গুণই ছিল লোকটার মধ্যে। দু’বার ঘানা আফ্রিকান নেশন্স কাপ জিতেছিল তাঁরই ডান পায়ের সৌজন্যে। শুধু তাই নয়, ১৯৬৫ আর ১৯৬৮-তে দু’বার টপ গোলস্কোরার হিসেবে নাম খোদাই করা রয়েছে গর্ব সহকারে।

আদর করে আসান্তে কোটোকোর সমর্থকরা ডাকতো ‘উইজার্ড’ বলে, এক এবং একমাত্র তাঁর ওই সুদৃশ্য ড্রিবলিংয়ের জন্য। ১৯৬১ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত আসান্তে কোটোকোতে ৩৪০ ম্যাচে ১৫১ গোল করা সেই কোফি শুধু রাজনৈতিক রোষের অনলে পুড়ে খেলতে পারলেন না বিশ্বকাপ।

তবে একজন কাছাকাছি গেছিলেন। মোজাম্বিকে জন্ম নিয়েও শুধু ফুটবলের জন্য পাড়ি দিলেন পর্তুগালে। আর সেখানেই একমাত্র আফ্রিকান বংশোদ্ভূত হয়ে অন্য সব টিমের নাকে দড়ি পরিয়েছিলেন এক কৃষ্ণাঙ্গ সেনা। গোটা কাপে করেছিলেন ৯ গোল। ভদ্রলোকের নাম ইউসেবিও দে সিলভা ফেরেইরা।

আর ইংল্যান্ড? পাঠক নিশ্চয়ই জানবেন, ওয়েম্বলিতে সেদিনের সেই ফাইনালের ১০১ মিনিটে কী ঘটেছিল। গোললাইন ক্রস না করা সত্বেও জিওফ হার্স্টের গোল বৈধ বলে স্বীকৃতি পেল। কাপ পেল না গোটা ম্যাচে অফুরন্ত দমে লড়ে যাওয়া জার্মানি। এটাও কি কম ডিসগ্রেসফুল? পাঠক, প্রশ্নের উত্তর বর্তালাম আপনার তরেই।

এরপরে ২০১০-এ প্রথমবারের মতো কোনও আফ্রিকান দেশ সমগ্র ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পেল। সেই বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই আগেরবারের রানার্স ফ্রান্স হারল দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে। ঘানা কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেও উরুগুয়ের কাছে হারল (সুয়ারেজ হাতে বল না লাগালে নিশ্চয়ই অন্য কিছুই হতো ম্যাচের ফল)।

কিন্তু ওই যে ১৯৬০ থেকে আফ্রিকায় ফুটবল বিপ্লব শুরু হল, তারই পতাকা বয়ে সমগ্র ইউরোপে রাজ করে বেড়ালো দিদিয়ের দ্রোগবা, যার এককথায় থেমে গেল দুই দেশের মধ্যে চলা গৃহযুদ্ধ। মাইকেল এসিয়েন, স্যামুয়েল এটোরা যার ধারক ও বাহক। তখন আড়ালে বসে কি মুচকি হাসতেন ওসেই কোফি? হয়তো তাই। কারণও তো ছিল ওই হাসির।

বিপ্লবের পথ যে তিনিই দেখিয়েছিলেন। নিজেকে বেস্টের থেকেও ছাপিয়ে নিয়ে গিয়ে। ডিসগ্রেসের মধ্যে গ্রেসের গোলাপ ফোটানোর প্রথম কারিগর যে তিনিই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link