বাংলাদেশের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্ট জিতে ১৬ মাসের জয়খরা কাটালো শ্রীলঙ্কা। দ্বিমুথ করুণারত্নে, লাহিরু থিরিমান্নে ও অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসদের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের একপাশে সরিয়ে কিনা সেই ম্যাচের নায়ক অভিষিক্ত প্রাভিন জয়াবিক্রমা যিনি এই ম্যাচের আগে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন মাত্র দশটি!
তাঁর নেয়া ১৭৮ রানে ১১ উইকেটের বোলিং ফিগার, ক্রিকেট ইতিহাসের কোনো অভিষিক্তের পক্ষে নেয়া দশম সেরা। আর অভিষেকেই বাঁ-হাতি স্পিনারদের জন্য এটা সর্বকালের সেরা বোলিং ফিগার।
অভিষেকের আগে মাত্র দশটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেললেও, জয়াবিক্রমা যে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে বড় তারকা হতে যাচ্ছেন সে ব্যাপারে আগেই ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন অর্জুনা রানাতুঙ্গা। হ্যাঁ ভুল পড়েননি, কিংবদন্তি অর্জুনা রানাতুঙ্গা, ১৯৯৬ বিশ্বকাপজয়ী শ্রীলঙ্কা দলের অধিনায়ক।
‘দশ বছর আগে হলিক্রস কলেজে একটি সারাদিনব্যাপী ট্রেনিং ক্যাম্প আয়োজন করা হয় স্কুলের ক্রিকেটারদের মাঝে। অর্জুনা ছিলেন তখন স্থানীয় সংসদ সদস্য। তাঁকে বলতেই তিনি সানন্দে রাজি হয়ে যান।’ শ্রীলঙ্কান পত্রিকা ‘দ্য আইল্যান্ড’ কে জানাচ্ছিলেন স্কুলেরই সাবেক ছাত্র সুনীল সিলভা।
তিনি বলেন, ‘আমার মনে পড়ে প্রাভিন প্রথম বলটা করার পরেই অর্জুনা পরের বোলারকে থামিয়ে দেন এবং তাকে ডেকে নিয়ে কথা বলেন। এরপর প্রাভিন আরো কয়েকটি বল করে। অর্জুনা তখন আমার দিকে তাকিয়ে বলেন সুনিল, আমি এই ছেলের মাঝে অজিত ডি সিলভাকে দেখতে পাচ্ছি।’
অজিত ডি সিলভা! শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটে এক আক্ষেপের নাম। ২৫ বছর বয়সী এই বাঁ-হাতি স্পিনার চারটি টেস্ট খেলার পরেই বোর্ডের সাথে বিরোধিতা করে ১৯৮২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যান। ফলশ্রুতিতে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। তিনি আর কখনোই শ্রীলঙ্কা দলে ডাক পাননি।
ওই ক্যাম্পের পরে রানাতুঙ্গা স্কুলের অধ্যক্ষের সাথে দেখা করেন এবং প্রাভিনের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চান।
‘অর্জুনা আমার সাথে দেখা করলেন এবং প্রাভিনের প্রসঙ্গে বলেন এই ছেলে বিরল প্রতিভা।কোনো সন্দেহ নেই সে একদিন শ্রীলঙ্কার জার্সি গায়ে ক্রিকেট খেলবে’ দ্য আইল্যান্ড’কে এভাবেই জানান তখনকার অধ্যক্ষ রেভারেণ্ড ফাদার ক্যামিলাস ফার্নান্ডো।
রানাতুঙ্গা তখন সপ্তাহান্তে বাচ্চাদের নিয়ে একটি ক্রিকেট অ্যাকাডেমি পরিচালনা করতেন এবং সেখানে তিনি প্রাভিনকে আমন্ত্রণ জানান। সেখান থেকেই প্রাভিন পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কা অনুর্ধ্ব-১৯ দলে জায়গা পান। ‘ছোট থাকতেই প্রাভিনের বাবা মারা যান।আমাদের চার সন্তান’ জানাচ্ছিলেন প্রাভিনের মা নিমালি।
তিনি বলেন, ‘প্রাভিন আমাদের দ্বিতীয় সন্তান। প্রাভিনের বড় ভাই ল কলেজে পড়াশোনা শেষ করেছে। আমাদের তৃতীয় ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছে। চতুর্থ জনও পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী। কেবল প্রাভিনই পড়াশোনা করতো নাহ, এমনকি সে পরীক্ষাও দিতো নাহ। পুরোটা সময় জুড়ে সে কেবল স্কুলের খেলা কিংবা অনুর্ধ্ব-১৯ দলের খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো।আমি তাকে কখনো খেলতে বাঁধা দেইনি।’
অর্জুনা রানাতুঙ্গা কলম্বোর বাইরের ক্রিকেটারদের সুযোগ-সুবিধা না পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করেন ‘দ্য আইল্যান্ড’-এর কাছে। তিনি বলেন ‘আমি সবসময়ই বিশ্বাস করে এসেছি কলম্বোর বাইরেও অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন ক্রিকেটাররা আছে।সনাথ জয়াসুরিয়া, মুরালিধরণ কিংবা হেরাথ, এরা সবাই কিন্তু বাইরের ছিলেন। কিন্তু আমরা বাইরের ক্রিকেটারদের উপর আস্থা রাখি নাহ। প্রাভিন জয়াবিক্রমা আর রমেশ মেন্ডিস দুজনে বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৭ উইকেট নিয়ে ম্যাচ জেতালো,দুজনেই কিন্তু বাইরের।’
‘প্রাভিন ভীষণ প্রতিভাসম্পন্ন বোলার। আমার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো তরুণ ক্রিকেটারদের গাইড করা, তাঁদের সামনে এগিয়ে নেবার পথ দেখানো। শৃঙ্খলা থাকাটা সবচেয়ে বেশি জরুরী।প্রতিভাধর আপনি হয়তো পেয়ে যাবেন কিন্তু আপনাকে পরিশ্রমী আর শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকতে হবে বড় কিছু অর্জনের জন্য’, বলেন কিংবদন্তি অর্জুনা রানাতুঙ্গা।
রানাতুঙ্গা আরো বলেন, ‘প্রাভিন এখনো পরিপূর্ণ বোলার নাহ। তাঁকে টেকনিক্যাল বিষয়গুলোতে আরো কাজ করতে হবে।তার ডানহাত অনেক দ্রুত নিচে নামছে বলে মনে হচ্ছে আমার। তাঁকে আরো বেশি ধৈর্য্যশীল হতে হবে। যদি সে মুরালির মতো অভিজ্ঞ কারো সাথে কথা বলতে পারে তাহলে সে আরো ধারালো হয়ে উঠবে। ব্যাটসম্যানকে পরাস্ত করার সকল ক্ষমতা তার মাঝে বিদ্যমান। কোনো সন্দেহ নেই আগামী কয়েক বছরের মাঝেই সে বিশ্বের অন্যতম সেরা বোলারে পরিণত হবে।’