খ্যাপাটে-লড়াকু-সেনাপতি

২৫ মে, ২০১৪। দিনটার কথা কি মনে আছে?

সেদিন নগর প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের মুখের গ্রাস কিভাবে কেড়ে নিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। সেই মূহুর্ত ভোলার নয় কখনো, যেমনটা কেউ ভুলবে না ৯২:৪৮ সংখ্যাটি আর তার দ্রষ্টা সার্জিও রামোসকে।

কী ঘটেছিল তখন? ঘটেছিল অনেক কিছু। ডিয়েগো সিমিওনের নজর ঘড়ির কাটায়, মাদ্রিদের লাল অংশ তৈরি আনন্দধারায় ভিজতে। ঠিক তখন রামোসের হেড, কালজয়ী হেড। ফুটবল ইতিহাসেই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এক হেডারে রিয়ালের লা দেসিমার পথে বিছানো কাটাগুলো সরে যায়। নির্বাক, মুমূর্ষ, আত্মহননের ক্ষণ গুনতে থাকা একেকজন ফিরে পায় বেঁচে থাকার শক্তি, আগ্রহ। অবিশ্বাস্য উপাখ্যানে মাদ্রিদ ছিনিয়ে নেয় প্রতিপক্ষের সাজানো বিজয় থালা, প্রথম ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বের লালিত স্বপ্ন।

এর আগে অভিন্ন আসরের সেমির মঞ্চে বিপক্ষ বায়ার্নের ডেরায় দুই গোল, দুটোই হেডার। সার্জিও রামোস এরপর মাদ্রিদকে বাঁচিয়েছেন উয়েফা সুপার কাপে সেভিয়ার বিরুদ্ধে, একাধিক লিগ ম্যাচে। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন কোচ থাকাকালে শেষ দশ মিনিটে ঘড়ি দেখতেন বারেবারে। ওই সময়টার নামই হয়ে গেছিল ফার্গি টাইম! রামোস তার পরের সময়টুকু নিয়েছেন। এক্সট্রা টাইমে দলের ত্রাতার ভূমিকায় একের পর এক ম্যাচে অবতীর্ণ হয়ে জন্ম দিয়েছেন রামোস টাইমের। আস্থা অনিশ্চয়তার দোলাচলে দুর্দান্ত আগ্রাসনে লিখেছেন নতুন উপাখ্যান।

অবিশ্বাস্য, অলৌকিক, কাকতালীয় বললেও কম বলা হবে। রামোস এমনই! ত্রাতার ভূমিকায় সর্বদা। সাধে তাকে ডাকা হয় না ‘এল গ্ল্যাডিয়েটর’ বাংলায় যা ‘যোদ্ধা’। পৃথিবীজোড়া নামডাক ছিল স্প্যানিশ ম্যাটাডোরদের। রামোস যেন বিলুপ্ত তাদের আধুনিক প্রতিচ্ছবি, ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। একজন খাঁটি ডিফেন্ডার কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে কার্যকরী এই রাইট ব্যাক হয়ে যান ইমার্জেন্সী স্ট্রাইকার!

মৌসুম চারেক আগে স্প্যানিশ দৈত্য রিয়াল মাদ্রিদের দলপতির বাহুবন্ধনী পাওয়া রামোসের ফুটবল পাঠ শুরু নিজ শহর ক্যামাসে। আট বছর বয়সে সেভিয়ার যুবদলে। ১০ বছর বয়সে ১৯৯৬ সালে প্রথম পদার্পণ সবুজ আ য়তক্ষেত্রে, ২০০৩ পর্যন্ত ছিলেন ওখানে। ‘০৩-এ তাকে নেওয়া হয় সেভিয়ার বি দলে। পরের বছর যাত্রা শুরু মূল দলের ব্যানারে। ২০০৪ এর পহেলা ফেব্রুয়ারি অভিষেক পেশাদারি জগতে।

সেভিয়ার জার্সিতে ৩৯ ম্যাচে অংশ নিয়েছেন, ফুটবল কলায় ছড়িয়েছেন মুগ্ধতা। এতটা যে, ২০০৫ সালে মাত্র ১৯ বছরের রামোসকে ২৭ মিলিয়নের বিনিময়ে দলে ভেড়ায় রিয়াল মাদ্রিদ! যখন কুড়ির কোঠা ছুঁতে যাওয়া কচি কাউকে এত দাম দিয়ে কেনা হয় তখন বুঝতে হবে বিশেষত্ব বিদ্যমান। দলটি যদি হয় রিয়াল তাহলে বলা যায় চোখ বুজেই। বলা বাহুল্য একযুগ পর ওই সাতাশ মিলিয়ন কম মনে হচ্ছে রামোসের জন্য।

ফুটবল মাঠে সার্জির গুরুত্ব কতটুকু তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। স্পেনের ইউরো-বিশ্বকাপ- ইউরোর ঐতিহাসিক ট্রেবল জয়ে ঝাঁকড়া চুলের রামোস ছিলেন দেল বস্কের অন্যতম তুরুপের তাস। দুর্দান্ত স্কিল, পাওয়ার শুট, দারুণ সব ট্যাকলিং পাসিংয়ে তিনি হয়ে আছেন আস্থার প্রতীক, ভরসার আরেক নাম। বিশ্বস্ততা অর্জন করেছেন সবার। ফর্মহীনতায় দলের বাইরে শেষ কবে ছিলেন ভুলে গেছেন রামোস নিজেও।

ফুটবলার রামোসের সামর্থ্য প্রশ্নাতীত। নেই কারো আঙুল তোলার দুঃসাহস। মাঠে একজন বিশুদ্ধ ফুটবলার, আদর্শ অধিনায়ক, ভদ্রতার এক নিদর্শিত উদাহরণ সার্জিও রামোস। দু’দলের হাতাহাতিতে সবার আগে পৌঁছে যান মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকায়। কার্ড প্রসঙ্গ সামনে আনবেন? সেটি ভিন্ন বিষয়। পেশাদারিত্বে এক চুলও ছাড় দিতে নারাজ, নারাজ নিজ দায়িত্বে অবহেলা করতে। ক্যারিয়ার শেষে রক্ষণভাগের কিংবদন্তিদের সাথে জুড়ে যাবে তার নাম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

হোসে মারিয়া- প্যাকুই রামোস দম্পতির তিন সন্তানের একজন সার্জিও। ১৯৮৬ সালের ৩০ মার্চ পৃথিবীর আলো দেখেন রিয়াল মাদ্রিদের দলপতি। রিয়াল মাদ্রিদে খেলার স্বপ্ন দেখতেন বুঝতে শেখার পর থেকেই, ‘আমার সকালে ঘুম ভেঙ্গেছে সেভিয়ার খেলোয়াড় হিসেবে, রাতে বিছানায় যাওয়ার সময় আমি মাদ্রিদের খেলোয়াড়। ভাবতেই শিহরিত হচ্ছি রাউল, জিদান, ব্যাকহামদের সঙ্গে লকার শেয়ার করবো যারা আমার আদর্শ।’

রিয়ালে কতজন এসেছে, কতজন যাবে। কালের পরিক্রমায় রামোসও অতীত হবে। আদতে হবে? ২০১২-‘১৫ পর্যন্ত টানা চারবছর মাদ্রিদের সেরা ডিফেন্ডার হওয়া তারকার ডেডিকেশন কতখানি তা কে না জানে। রামোসকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কি আপনার দলের সেরা খেলোয়াড়? তখনো রিয়ালে আসেনি সে। তার জবাবটাই প্রমাণ দেয় তাকে, জানান দেয় তার স্পৃহাকে, ‘আমি কখনোই সেরা ছিলাম না। তবে আলাদা ছিলাম। আমার দৃঢ়তা, আমার স্বপ্নই আমাকে বাকিদের চেয়ে আলাদা করেছে।’

২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবার রামোস এবং সাংবাদিক-উপস্থাপিকা প্রেমিকা পিলার রুবিও নিজেদের সম্পর্কের কথা জনসমুক্ষে প্রকাশ করেন। ২০১৪ এর মে মাসে জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান সার্জিও, ২০১৮ এর মার্চের শেষ সপ্তাহে পৃথিবীর আলো দেখে তৃতীয়জন, আলেজান্দ্রো। মাঝে ২০১৫ সালের নভেম্বরে রামোস পরিবারে যুক্ত হন মার্কো, দ্বিতীয় সন্তান। বুলফাইটের দারুণ ভক্ত রামোস নিজের এলাকার জনপ্রিয় খেলাটির একজন নিয়মিত দর্শকও।

রিয়াল মাদ্রিদ যদিও আর তাঁর ঠিকানা নেই। তিনি চলে গেছেন পিএসজিতে। তবে, রিয়ালের প্রতি তাঁর চেয়ে ভালবাসা, কিংবা রিয়াল-ভক্তদের তাঁর প্রতি যে মমত্ববোধ – সেটা কমেনি এক বিন্দুও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link