আইপিএল ফাইনালে ওঠার সাথে চেন্নাই সুপার কিংসের সম্পর্কটা বরাবরই মধুর। এখন পর্যন্ত ১৪ আসরে অংশ নিয়ে ১০ বারই ফাইনাল খেলার কীর্তি গড়েছে দলটা। যার সর্বশেষটা হলো, চিপকের চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে প্রথম কোয়ালিফায়ারে গুজরাট টাইটান্সকে হারিয়ে।
মহেন্দ্র সিং ধোনির দল তাই আবারো ফাইনালে। আগের নয় ফাইনালের প্রত্যেকটিতেই ছিলেন ক্যারিবিয়ান অলরাউন্ডার ডোয়াইন ব্রাভো। এবারও দলের সাথে রয়েছেন। তবে খেলোয়াড় হিসেবে নয়, কোচিং স্টাফের অংশ হয়ে এবার দলকে আড়ালে থেকে দেখিয়েছেন পথ।
আর সেই পথ ধরেই তুষার দেশপাণ্ডে, দীপক চাহার, মাথিশা পাথিরানাদের নিয়ে গড়া পেস বোলিং ইউনিট এবার চেন্নাইকে ফাইনালের মঞ্চে নিয়ে আসলো।
একদম ভেঙ্গে গড়া নতুন একটা বোলিং লাইন আপ। যে বোলিং লাইন আপকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখাতে পারে খুব কম মানুষকেই। তবে চলতি আইপিলে সবাইকে অবাক করে দিয়ে চমক দেখিয়েছে তুষার দেশপাণ্ডে, পাথিরানারাই।
অথচ শুরুটা কিন্তু ততটাও মসৃণ ছিল না। দেদারসে রান দিয়েছেন দেশপাণ্ডে। বড় মঞ্চে টানা এমন খরুচে বোলিং করলেই দল থেকে বাদ পড়ার কথা। কিন্তু দেশপাণ্ডের কাঁধ থেকে হাত সরাননি ধোনি। আস্থা রেখেছেন। আর ডোয়াইন ব্রাভো তো স্ট্র্যাটেজিক টাইমআউটেও ধরে ধরে তাঁর শিষ্যকে শিখিয়েছেন।
ব্রাভো-দেশপাণ্ডে, গুরু-শিষ্যের এমন একটা দৃশ্যপটের কথাই টেনে আনা যাক। লখনৌ সুপারজায়ান্টসের বিপক্ষে ম্যাচ। চেন্নাইয়ের দেওয়া ২১৮ রানের লক্ষ্যে লখনৌর নিকোলাস পুরান তখন ব্যাট হাতে ভয়ংকর হতে শুরু করেছেন। ১০ বলে ১৮ রানে তখন তিনি ক্রিজে, আর দলের রান ১৪ ওভারে ১৩৮।
এমতাবস্থায় স্ট্র্যাটেজিক টাইম আউটের সময় ব্রাভো দেশপাণ্ডে পরের ওভারের সব কটা বলই অফসাইট ইয়র্কার মারতে বললেন। ডোয়াইন ব্রাভোর কথা অনুযায়ী পরের ওভারেই তুষার দেশপাণ্ডে বল করলেন অফসাইড ইয়র্কার লেন্থে।
ধোনি তার আগেই ৩ জন ফিল্ডারকে সরিয়ে অফসাইডে রেখেছিলেন। ব্যাস, ব্রাভো, ধোনি আর দেশপাণ্ডের পাতা ফাঁদে ধরা দেন নিকোলাস পুরান। দেশপাণ্ডের করা অফসাইড ইয়র্কার লেন্থের বল উড়িয়ে খেলতে গিয়ে ক্যারিবিয়ান এ ব্যাটার ক্যাচ দেন বেন স্টোকসের হাতে।
শুধু দেশপাণ্ডে নয়, চেন্নাই সুপার কিংস এবার বোলারদের ব্যবহার করেছে একদম যথাযথভাবে। দীপক চাহার নতুন বলে ভাল বোলিং করেন। তাই তাঁকে দিয়ে পাওয়ার প্লে-তেই বল করানো হয়েছে। চেন্নাই তাতে সফল হয়েছে। এবারের আইপিএলে পাওয়ার প্লে-র পরিসংখ্যান বলে, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর পরে পাওয়ার প্লে-তে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৪ টি উইকেটে নিয়েছে চেন্নাইয়ের বোলাররা।
লঙ্কান পেসার মাথিশা পাথিরানার ক্ষেত্রে আবার নতুন বল নয়, বল পুরনো হলেই তাঁর সুইং বিষ তীব্র হয় আর ইয়র্কার লেন্থে টানা বল করতে পারেন তখনই। অধিনায়ক ধোনি, এ পেসারকে ঠিক সেভাবেই ব্যবহার করেছেন। সিংহভাগ ম্যাচেই ১০ ওভারের পরে বোলিং প্রান্তে এনেছেন। আর ধোনির এ রণকৌশলে পাথিরানা নিজের সেরাটাও দিতে পেরেছেন।
একই সাথে লঙ্কান এ পেসার ডেথ ওভারেও দেখিয়েছেন নিজের বোলিং মুনশিয়ানা। এবারের আইপিএলে ডেথ ওভারে চেন্নাইয়ের বোলাররা কতটা দুর্দান্ত ছিল, তার প্রমাণ দেয় ১৬-২০ ওভারের মাঝে সর্বোচ্চ ২৯ উইকেট প্রাপ্তির হিসেবটা। চেন্নাইয়ের মতো গুজরাটের বোলাররাও অবশ্য ডেথ ওভারে ২৯ টা উইকেট নিয়েছে।
ডোয়াইন ব্রাভোর আইপিএল থেকে অবসরের ঘোষণার পরই একটা প্রশ্ন উঠেছিল, এবার তবে চেন্নাই শিবিরে ডেথওভারের দায়িত্ব কার কাঁধে উঠবে? সেই প্রশ্নের উত্তর মিলতে বিলম্ব হয়নি।
মাথিশা পাথিরানা নামের তরুণ এক পেসার ডোয়াইন ব্রাভোর অভাব ঘুচিয়েছেন দুর্দান্তভাবে। একই সাথে সময়ের ব্যবধানে বোলিংয়ের দারুণ উন্নতি ঘটিয়ে ডেথ ওভারেও দারুণ দক্ষতা দেখিয়েছেন তুষার দেশপাণ্ডে।
ডেথ ওভারে বোলিং করার জন্য প্রয়োজন নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস আর অসম চাপ কাটানোর সক্ষমতা— প্লে-অফ নিশ্চিত হওয়ার এমনটাই জানিয়েছিলেন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি।
তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় এ সময়ে আত্মবিশ্বাসটাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কেউ যদি দেশপাণ্ডেকে দেখেন, সে কিন্তু ক্রমান্বয়ে উন্নতি করেছে বোলিংয়ে। এর একটাই কারণ তাঁর নিজের বোলিংয়ের প্রতি আত্মবিশ্বাস ছিল। চাপের মুহূর্তেও সে বল করতে পারে নির্দ্বিধায়। আর পাথিরানার প্রকৃতিগত কিছু ব্যাপার আছে। আমাদের দলের জন্য দুর্দান্ত এক সম্পদ হতে যাচ্ছে।’
আইপিএল ফাইনালে ওঠার সাথে চেন্নাইয়ের দারুণ সম্পর্কের ইতিহাস থাকলেও চেন্নাইয়ের ফাইনাল ভাগ্যে আবার জড়িয়ে আছে অম্ল-মধুর, দুটো স্মৃতিই। কেননা আগের ৯ ফাইনালের ৫ টিতেই হেরেছিল ধোনির চেন্নাই। এবারের ফাইনাল জিততে পারলে পঞ্চমবারের মতো শিরোপা উঁচিয়ে ধরবে দলটা। সেই যাত্রায় তাঁরা ছুঁয়ে ফেলবে মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের সর্বোচ্চ ৫ আইপিএল শিরোপা অর্জনকেও।
এখন দেখার পালা, চেন্নাইয়ের আলোচিত এই বোলিং লাইনআপ ফাইনালটা ঠিক কতটা রাঙাতে পারেন। অবশ্য ফাইনাল জয় না হলেও, চেন্নাই যে ভবিষ্যতের বোলিং লাইনআপ এই আসর দিয়েই পেয়ে গেছে, সেটাই বা কম কিসে! প্রাপ্তির হিসেবে দেশপাণ্ডে, পাথিরানারাই তো যে কোনো দলের জন্য অমূল্য সম্পদ।